২০২২ সালে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো, ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা করি, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসি’। অর্থাৎ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করলে শুধু যে প্রজাতিসমূহ সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে তা না, বরং তা আমাদের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ সরকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে নানাভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। তবে বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে প্রায়ই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। অবৈধভাবে বনভূমি দখল, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, ব্যক্তি বা সরকারী মালিকানাধীন পাহাড় কেটে ভূমিরূপ পরিবর্তনের ফলে আশংকাজনক হারে বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হমকির সম্মুখীন হয়। 

যত দিন যাচ্ছে, বন ও জলাভূমির পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমছে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের পরিমাণ যত কমছে, খাদ্যসংকট, আশ্রয়সংকট ও অন্যান্য কারণে তত কমছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যাও। আবাসস্থলে খাদ্যের প্রাচুর্যতা কমে যাওয়ায় দিশাহীন হয়ে পড়ছে ওরা, টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে নিজেদের। এছাড়াও পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে বর্ধিত পরিমাণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার কারণে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মারা পড়ছে অসংখ্য বন্যপ্রাণী। তদুপরি খাদ্যসংকটে লোকালয়ে চলে আসছে অনেক প্রজাতির প্রাণী, বাড়ছে মানুষের সাথে সংঘাত। পাশাপাশি মানুষের সীমাহীন লোভ লালসার কারণে শিকারে পরিণত হচ্ছে। এভাবে অসচেতনতা, হিংস্রতা, বুভুক্ষা ইত্যাদি কারণে মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে অনেক প্রাণী। এর ফলে কোনো বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কেউ রয়েছে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আমরা এই নিবন্ধে বন্যপ্রাণীর জন্য যেসব হুমকি রয়েছে, যেমন – আবাসস্থল কমে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ শিকারসহ নানা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ আলোচনা করবো।

5.1 বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের অতীত ও বর্তমান অবস্থা

5.1.1 বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়া

গত পাঁচ দশকে, বাংলাদেশ তার বনভূমির দুই-তৃতীয়াংশ হারিয়েছে। যার প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের উপর। বন ছাড়াও সমুদ্র, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, বাড়ির পাশের ঝোপ-ঝাড় অর্থাৎ আমাদের গ্রামীণ পরিবেশের সর্বত্র কোনো না কোনো বন্যপ্রাণীর আবাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাসস্থানের বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে বন্যপ্রাণী আবাসস্থল নিধন বা সংকোচনের মাধ্যমে। অধিকতর প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্পায়ন, নগরায়ন তথা অপরিকল্পিত উন্নয়ন ছাড়াও আর্থিক লাভের আশায় সৃজিত বাগান (সেগুন, রাবার, চা), এবং পাহাড়ে অনিয়ন্ত্রিত জুমচাষ, অপরিকল্পিত হর্টিকালচার সম্প্রসারণকে বন নিধন তথা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

5.1.2 বন ও জলাভূমি হ্রাস

কোন বন বা জলাভূমির পরিমাণ প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট কারণে কমে গেলে তাকে উজাড় (হ্রাস) বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজার জেলায় সংরক্ষিত বনভূমিতে বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিক (রোহিঙ্গা) কর্তৃক বসতি স্থাপন, বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বনভূমি থেকে জ্বালানী সংগ্রহ, পাহাড় কেটে ফেলে মাটি বিক্রি করা, অবৈধভাবে কাঠ ও বনদ্রব্যাদি পাচার, স্থানীয় প্রভাবশালী ও কুচক্রীমহল কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেমন বনভূমি জবরদখল ও অবৈধভাবে বনের গাছ কাটা ও পাচারের কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা, স্বল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণস্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি কাজের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হওয়া। এসকল কারণে প্রায় ২ হাজার একর সৃজিত বন ও চার হাজার একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণের কারণে প্রতিনিয়ত পাহাড় ও বনভূমি কাটা পড়ছে। 

এছাড়াও, বিভিন্ন জলাভূমি ভরাট করে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন জলাভূমি নদী, খাল ইত্যাদির পাড় ধরে কলকারখানা, রেস্টুরেন্ট, বস্তি ইত্যাদি স্থাপন্নের মাধ্যমে ক্রমশ সংকুচিত করে ফেলা হচ্ছে জলাভূমিগুলোকে। অনেক জায়গায় বিস্তীর্ণ জলাভূমি দখল করে গড়ে উঠছে আবাসিক প্রকল্প। হাওড়ের বিভিন্ন অংশ দখল করে ফিশারি বানানো হচ্ছে। প্লাস্টিক, পচনশীল ও অন্যান্য অপচনশীল আবর্জনা ফেলার কারণেও ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাভূমিগুলো, পানির স্বাভাবিক গতিপথ বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, যে কারণে ভাটির দিকে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী ও খালগুলো। 

জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও মানুষের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের কারণে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়েছে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান সুন্দরবন। এসকল কারণ ছাড়াও নদী-ভাঙ্গনের ফলে দিনের পর দিন বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের বনের অংশ।

5.1.3 বন ও জলাভূমির অবক্ষয়

বন ও জলাভূমির কোন অংশ যদি কোনো কারণে বন্যপ্রাণীর বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে তা অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিভিন্ন কারণে বন ও জলাভূমির অবক্ষয় হতে পারে। বনে অবৈধভাবে গাছ কাটার ফলে বনের গাছগুলোর ঘনত্ব কমে যাচ্ছে। বন ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি, বন ও জলাভূমি বাস্তুতন্ত্রকে যেসব সেবা প্রদান করতো, যেমনঃ অক্সিজেন প্রদান, খাদ্যদ্রব্যের যোগান ইত্যাদি, সেগুলোও হ্রাস পাচ্ছে। এভাবে অবক্ষয় ঘটছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের। 

এছাড়াও জলাভূমিতে ঘের দিয়ে বা বাঁধ দিয়ে চিংড়ির ঘের, ফিশারি ও অন্যান্য কার্যক্রম করছে লোভী দখলদারেরা। মাছ শিকারের জন্য বিষ প্রয়োগ ও অন্যান্য ক্ষতিকর পন্থা অবলম্বনের কারণেও জলাভূমির অবক্ষয় ঘটছে।

5.1.4 বন খণ্ডায়ন

বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল কমে যাওয়ার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বনের খণ্ডতা বা Fragmantation, অর্থাৎ একটি বড় বনকে কোনো কারণে খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করে ফেলা যার এক অংশের সাথে আরেক অংশের কোনো যোগাযোগ নেই। ধরো, তোমার জেলায় একটি অনেক বড় শালবন আছে, সেখানে অনেক ধরনের প্রাণী বাস করে। এবার, সেই বনের ভিতর দিয়ে রাস্তা বানানো হলো, রাস্তার দুইপাশে বাজার হলো, ধীরে ধীরে মানুষের বসতি বাড়তে থাকলো। এতে করে কী হলো? বনটি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একভাগের প্রাণীরা আর অন্যভাগে যেতে পারছে না বাজার ও ব্যস্ত রাস্তা থাকার কারণে। ফলে বনের প্রাণীদের বিচরণের জায়গাও অর্ধেক হয়ে গেল, এদের চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহের স্থানও সংকুচিত হয়ে পড়লো। পরিণামে ধীরে ধীরে এদের সংখ্যা কমতে শুরু করবে, এমনকি ছোট বনের ছোট দল হওয়ায় এদের অভিযোজন ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকবে এবং এভাবে কমতে কমতে একসময় হয়তো দলটি বিলুপ্তই হয়ে যাবে ঐ বন থেকে। অথচ পুরো বন একসাথে থাকলে, এদের দলের সংখ্যা আরও বড় থাকলে (যেমনটি শুরুতে ছিল) এরা হয়তো বিলুপ্ত হতো না।

5.1.5 অন্যান্য

প্রায়ই জেলেদের জালে অনাকাঙ্খিত কিছু প্রাণী ধরা পড়ে। জেলেদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মাছ ধরা, মাছ ধরতে গিয়ে এসব প্রাণী জালে আটকে গেলে এসব প্রাণীরও ক্ষতিসাধন হয়। অবমুক্ত করে জলে ফিরিয়ে দেওয়ার আগেই প্রাণীটি মারা যায়, অথবা জালে আটকে গিয়ে প্রাণীটি মারাত্মকভাবে আহত হয়, অথবা জেলেরা প্রাণীটাকে আর জলে ফিরিয়ে দেন না, বাজারে সুলভমূল্যে বিক্রি করে দেন, অথবা কোথাও ফেলে রাখেন যেখানে প্রাণীটি মারা যায়। কাছিম, করাত মাছ, বিভিন্ন প্রকার হাঙ্গর, শাপলাপাতা ও অন্যান্য প্রাণী ধরা পড়ছে জেলেদের জালে, যার কোন সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। অবশ্য জেলেদের মতে আমাদের জলসীমানায় হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ আর আগের মত আর ধরা পড়ছেনা। এর অর্থ হলো, তাদের সংখ্যা উল্লেখজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। 

বিভিন্ন খাল-বিল, নদী ও জলাশয়ে চায়না ম্যাজিক ও কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার চলছে। বিভিন্ন ধরনের জাল বিভিন্ন ধরনের জলাভূমির প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য সব জলাভূমিতে সব ধরনের জাল দিয়ে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়না। তবুও অবৈধভাবে বিভিন্ন নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার চলছেই। এতে যেসব প্রাণীর ধরা পড়ার কথা না, জালে আটকে ধরা পড়ছে তারাও। নিধন হচ্ছে দেশীয় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। এছাড়াও প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির ডিমওয়ালা মাছ। মারা পড়ছে বিভিন্ন মাছের পোনাও। ব্যাঙ, সাপ, কচ্ছপ, শামুকসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীও মারা পড়ছে। ফলে হুমকিতে পড়ছে তাদের জীবনচক্র, হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এসব জাল ব্যবহারের কারণে মুক্ত জলাশয়ের মাছ শেষের পথে, এখন আর আগের মতো মাছ দেখা যায় না। আশংকাজনক হারে কমে গিয়েছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও।

5.2 আবাসস্থল হারিয়ে যাওয়ার ফলাফল

5.2.1 খাদ্য ও পানির সংকট

বনভূমি সংকুচিত হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, ফলদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় গাছপালা নির্বিচারে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। একেক ধরনের প্রাণী একেক ধরনের গাছের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল থাকে খাদ্যসংগ্রহ বা আশ্রয়ের জন্য। সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হলে তার উপর নির্ভরশীল প্রাণী, যারা প্রথম শ্রেণির খাদক, তারা হয় খাদ্যাভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় নয়তো লোকালয়ে চলে এসে মারা পড়ে। এবার, তাদের বিলুপ্তির কারণে তাদের উপর নির্ভরশীল দ্বিতীয় শ্রেণির প্রাণীদেরও একই পরিণতি বরণ করতে হয় এবং এই ধারা চলতেই থাকে। এছাড়াও গাছ কাটার ফলে মাটির পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে শীতের মৌসুমে দ্রুতই শুকিয়ে যাচ্ছে জলাধারগুলো। লাউয়াছড়াসহ অন্যান্য বন বিশেষতঃ পার্বত্য বনভূমিতে ঝিরিগুলো শীতের শুরুতেই শুকিয়ে যাচ্ছে। চরম পানিসংকটে পড়ছে উক্ত এলাকার বন্যপ্রাণী।

5.2.2 আশ্রয়ের সংকট

আবাসস্থলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ও বনগুলোতে গাছের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় আশ্রয়ের সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণীরা। সম্মুখ বিপদ, মানুষ ও অন্যান্য হুমকি থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নিজেদের আড়াল করতে পারছে না প্রাণীরা। তাদের লুকানোর স্থানগুলো ও আশ্রয়স্থলগুলো বিভিন্ন কারনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ফলে বন্যপ্রাণীরা বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না, বারবার উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে।

5.2.3 চলাচলের সংকট

তোমরা অনেকেই জানো যে হাতি কখনোই এক জায়গায় বসবাস করে না, একটি হাতির দলের যে পরিমাণ খাবারের প্রয়োজন হয়, তার যোগান নিশ্চিত করতে ও অন্যান্য কারণে তারা এক বনভূমি থেকে অন্য বনভূমিতে যাতায়াত করে। এই পথগুলো সাধারণত রক্ষিত এলাকার সীমান্তবর্তী এলাকায় হয়ে থাকে। মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও স্থাপনার ফলে এই যাতায়াতের পথ ও করিডোরগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ছে। মূলতঃ উখিয়া, টেকনাফ ও রামু উপজেলার বনভূমিতে এরা বসবাস করলেও পানেরছড়া-রাজারকূল এবং বালুখালী-ঘুনধুম করিডোর দিয়ে এরা বান্দরবান ও মায়ানমারে চলাচল করত। সরকারী বেসরকারী স্থাপনা নির্মাণ এবং রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রের ফলে এই দুইটি করিডোরসহ অন্যান্য করিডোরগুলোর কয়েকটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে, কয়েকটি বন্ধ হয়ে পড়েছে। পরিণামে হাতির পাল ক্রমেই ক্ষুদ্র জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, তাদের খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে, প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

5.2.4 মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত

আবাসস্থল সংকোচন ও অবক্ষয়ের কারণে বন্যপ্রাণীরা ক্রমেই ক্ষুদ্র জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, তাদের খাবারের অভাব দেখা দিচ্ছে, প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। হাতির দল বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ের দিকে চলে আসছে, হাতি ও মানুষের মধ্যকার সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। হাতির আক্রমণে মানুষ মরছে, নয়তো মানুষের আক্রমণে হাতি। ২০২১-২২ সালে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্বে ১৩টি হাতি মারা যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে খাদ্য ও পানির সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসছে মায়া হরিণ, শূকর, বানর, হনুমান, সজারু, বনরুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। ময়মনসিংহের রসূলপুর ও টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে খাদ্যের সংকটে লোকালয়ে বানর, হনুমান ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের চলে আসার খবর শোনা যাচ্ছে কদিন পরপরই। 

সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন জাতীয় উদ্যানে খাদ্য সংকটের প্রকটতা দিনকে দিন বাড়ছেই। লোকালয়ে এসে নির্বিচারে প্রাণ হারাচ্ছে এসব বন্যপ্রাণী। সাতক্ষীরা অঞ্চলের সুন্দরবন অংশে বাঘ অনেকবার নদী সাঁতরে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে খাদ্য সংকটের কারণে। লোকালয়ে প্রবেশের পর অনেক বাঘকেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেছো বিড়াল পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। 

মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বাড়ায় শুধু যে বন্যপ্রাণীর জীবন চলে যাচ্ছে তা নয়, মারা যাচ্ছে মানুষও। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে সাপের কামড়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর চার লাখ তিন হাজারের বেশি মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। আবার দংশনের পর মানুষের পিটুনিতে মারা পড়ছে সাপটিও।

খাদ্যসংকটে ফসলের মাঠে বন্য শূকরের হানায় বিভিন্ন এলাকায় নষ্ট হচ্ছে ধান ও সবজিক্ষেত। এর মধ্যে মৌলভিবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা উল্লেখযোগ্য। সেখানের ফসলি জমিতে লাউয়াছড়া বনের শুকরের দল প্রায় প্রতি রাতেই হানা দেয়। পাকা আমন ধান ও শীতকালীন সবজিক্ষেতে প্রায় প্রতি রাতেই শূকরের দল এসে ফসল নষ্ট করে। ধান, আলু, মূলাসহ বিভিন্ন ফসল উপড়ে ফেলে। শীতের মধ্যে পাকা ধান রক্ষায় মাঠে বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে পাহারা দিতে হয় কৃষকদের। অনুরূপভাবে সজারুর কারণেও অনেক সবজিক্ষেতের কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যদিও বর্তমানে সজারুর সংখ্যা অত্যন্ত কমে যাওয়ায় সবজিক্ষেতে হানা দেওয়ার কথা আর তেমন শোনা যায়না। 

লাওয়াছড়া বনের ভেতর ও আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায়শই উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন বন্যপ্রাণী ও পাখি উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে নীলগাই, লেওপার্ড পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত অজ্ঞানতা ও অসচেতনতাই দায়ী।

5.2.5 প্রজননে সমস্যা

বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণজনিত সমস্যা ও আবাসস্থল সংকোচনের ফলে বন্যপ্রাণীর প্রজননেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যদিও বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে বন্যপ্রাণীর প্রজনন সহায়ক, তবুও নদীর ঘড়িয়াল, কয়েক জাতের বানর ও হনুমান, ডলফিন, উদবিড়াল, শকুন, সুন্দরী হাঁস, পালাসের কুড়া ঈগলসহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রজনন সহায়ক পরিবেশ তৈরি একান্ত আবশ্যক। পূর্ব সুন্দরবনে করমজলে বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করছে। বিভিন্ন পরিযায়ী পাখিসহ দেশি পাখির প্রজনন স্বাস্থ্য বনাঞ্চলের প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে, যা আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ার কারণে আজ হুমকিস্বরূপ। এছাড়াও আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনীতিবিদদের প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতা, বন-নির্ভর জনগোষ্ঠীর বনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ইত্যাদি কারণেও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিচ্ছে। 

5.2.6 বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাস

দিনদিন কমে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। Red list of Bangladesh (2015) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬১৯ প্রজাতির মধ্যে ৫৬ টি প্রজাতি (৩.৪৫%) মহাবিপন্ন, ১৮১টি প্রজাতি (১১.১৮%) বিপন্ন, ১৫৩ টি প্রজাতি (৯.৪৫%) সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। সমগ্র দেশজুড়ে ৩৮ টি স্তন্যপায়ীর প্রজাতি, ৩৯ টি পাখির প্রজাতি, ৩৮ টি সরীসৃপ প্রজাতি, ১০টি উভচর প্রজাতি, ৬৪ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ এবং ১৮৮টি প্রজাপতির প্রজাতি হুমকির মধ্যে আছে। 

ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী, ২০০৬ সালে সুন্দরবনে ৪৫১ টি ইরাবতী ডলফিন এবং ২২৫ টি শুশুক (রিভার-ডলফিন) ছিল। অথচ বন বিভাগের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১১৩তে এবং শুশুক ১১৮তে।

5.2.7 বিলুপ্তি

বন্যপ্রাণীর সংখ্যাহ্রাস ঘটতে ঘটতে একসময় একটি প্রজাতির সর্বশেষ সদস্যটিও হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে, বা একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চল থেকে। প্রজাতিটি বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়। Red list of Bangladesh (2015) এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৬১৯ প্রজাতির মধ্যে ৩১ টি প্রজাতি (২%) আঞ্চলিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইতঃপূর্বে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বুনোমহিষ, জলার হরিণ, জাভান গন্ডার সহ আরো অনেক প্রজাতি। বিলুপ্ত হওয়া এসব প্রাণীদের মধ্যে কয়েকটি স্তন্যপায়ী ও পাখির নাম নিচে উল্লেখ করা হলো –

স্তন্যপায়ী

ক্রমিক নং বাংলা নাম ইংরেজি নাম
০১. একশিং-বিশিষ্টবৃহৎ গণ্ডার Great One-horned Rhinoceros
০২. ক্ষুদ্রএকশিং-বিশিষ্টগণ্ডার Lesser One-horned Rhinoceros
০৩. এশীয়দু’শিং-বিশিষ্টগণ্ডার Asian Two-horned Rhinoceros
০৪. নীলগাই Blue Bull or Nilgai
০৫. বুনোমহিষ Wild Buffalo
০৬. গাউর Gaur
০৭. বেন্টিং Banteng
০৮. বারোশিঙ্গা Swamp Deer
০৯. প্যারাহরিণ Hog Deer
১০. নেকড়ে Wolf

পাখি

ক্রমিক নং

বাংলা নাম ইংরেজি নাম
০১. গোলাপিহাঁস Pinkheaded Duck
০২. বর্মীবানীলময়ূর Burmese Peafowl
০৩. বৃহৎ হাড়গিলা Greater Adjutant
০৪. রাজাশকুন King/Black Vulture
০৫. ডাহর/বেঙ্গলফ্লোরিকেন Bengal Florican

5.2.8 প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপদের সম্মুখীন হয় বন্যপ্রাণীরা। যেমন, জলোচ্ছ্বাসের সময় সুন্দরবন থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে লোকালয়ে চলে আসে হরিণ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী। বিভিন্ন সময়ে শরণখোলা রেঞ্জ, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে ভেসে যাওয়া জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের ভিতরে অনেক জায়গা তলিয়ে যায়। হরিণ, শুকর ও বাঘের শাবক পানি বেশি হলে ঠাঁই পায় না। তখন প্রাণীরা বনের মধ্যে উঁচু জায়গা খুঁজতে চেষ্টা করে। অনেক সময় তাদের বাচ্চা ভেসে যায়।

পানিতে ভেসে আসা ছাড়াও বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কারণে বন্যপ্রাণীর ক্ষতি হতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বনের অভ্যন্তরে লবণাক্ত পানি ঢুকে নষ্ট করে দিতে পারে সুপেয় পানির উৎসগুলো। সুন্দরবনে বেশ কিছু সুপেয় পানির পুকুর খনন করা হয়েছে। এসব পুকুরে নোনাপানি ঢুকে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীরা সুপেয় পানির অভাবে পড়ে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দুর্যোগ হলো বন্যা। বন্যায় যখন বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল পানির নিচে তলিয়ে যায়, বন্যপ্রাণীরা তখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। সাপ, বেজি, শিয়ালসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর জীবন তখন হুমকির মুখে পড়ে। অনেক প্রাণী পানিতে ভেসে যায়, খাদ্যাভাবে ও পানিতে ডুবে মারা পড়ে অনেক বন্যপ্রাণী, অনেক প্রাণী অপেক্ষাকৃত উঁচু লোকালয়ে চলে আসে আশ্রয়ের খোঁজে। এজন্য বন্যার সময়ে বাসাবাড়িতে সাপ আশ্রয় নিতে দেখা যায়। সাপের কামড়ে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে।

পাহাড়ি ঝিরিগুলো থেকে অবাধে পাথর উত্তোলনের ফলে পাহাড়ি নদী ও ঝিরিগুলোর প্রবহমানতা কমে গিয়েছে। পাহাড়ে বড় বড় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মাটি ধুয়ে ঝিরিগুলোতে পড়ে সেগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই পাহাড়ি ঢল নেমে আসছে পাহাড় থেকে, অতিবৃষ্টিতে আকষ্মিক বন্যায় পাহাড়ি নদীগুলোর দুইতীর প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলগুলো, পাহাড়ি ঢলে দুই তীর প্লাবিত হওয়ায় বাসস্থান হারাচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী।     

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধ্বসে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, অনেক বন্যপ্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাটির নিচে চাপা পড়ে মারা যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। ঝিরি ও অন্যান্য সুপেয় পানির উৎসগুলোর প্রবাহও বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ভূমি বা পাহাড় ধ্বসের কারণে। পাহাড় ধ্বসের কারণ হিসেবে পাহাড় কাটা, অবাধে গাছ কাটা, অপরিকল্পিত আবাসন, অনিয়ন্ত্রিত জুম চাষ এবং অতিবৃষ্টি উল্লেখযোগ্য।

দুর্যোগের কারণ প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট যাই হোক না কেন, বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

5.2.9 পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন

সাম্প্রতিক সময়ে বন্যপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। শিল্পায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে হচ্ছে এসিড বৃষ্টি যার ফলে অরণ্যে মহামারীর সৃষ্টি হচ্ছে, খাদ্যশস্য বিষাক্ত হচ্ছে। আমাদের সবুজ অরণ্যগুলো খুব দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের বনভূমির প্রায় ৮০ শতাংশই কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সবুজ অরণ্য। শুধু অরণ্যই নয়, কৃষিজমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফলে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা। সুন্দরবনে জেলেদের জাল ও বিষ প্রয়োগের কারণে বিভিন্ন মাছ, কুমির ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। শিল্প কারখানার বর্জ্য দূষণ এবং নৌযান চলাচলের ফলে সৃষ্ট দূষণের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে কুমির ও ডলফিনের স্বাভাবিক প্রজনন। 

যত্রতত্র প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ফেলা হচ্ছে। প্লাস্টিকের বোতল ও মোড়ক, পলিথিন, অন্যান্য পচনশীল ও অপচনশীল দ্রব্য নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলায় সেগুলো পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে, বিভিন্ন জলাশয় ও নদীনালায় এসে জমা হচ্ছে। জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, নদীনালার স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে যাচ্ছে প্লাস্টিকের কারণে, জলাভূমিগুলো প্রাণীদের বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ইট ভাটার কারণে পরিবেশ ও বায়দূষণ ঘটছে। অন্যান্য কলকারখানা ও যানবাহন বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এছারাও উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাটির উপরিভাগও। বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। 

কৃষিক্ষেত্রে শস্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন করা হচ্ছে নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে। এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে বন্যপ্রাণীর শরীরে। জলাভূমির পরিবেশ নষ্ট হয়ে অক্সিজেন স্বল্পতা ও অন্যান্য বিষাক্ততায় প্রাণীশুন্য হয়ে পড়ছে জলাভূমিগুলো। বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর জলবায়ু। গরমের তীব্রতা বাড়ছে, বাড়ছে শীতও, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পরিণত হচ্ছে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায়। বদলে যাচ্ছে অরণ্যগুলো, খাপ খাওয়াতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী।

5.2.10 বন্যপ্রাণীর অবৈধ শিকার ও বাণিজ্য

বিভিন্ন দেশে কচ্ছপ, হরিণ, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী বা প্রাণীর অংশবিশেষের চাহিদা রয়েছে। দেশের ভিতরেও অনেকে শখের বশে বা অন্য কোনো কারণে হাতির দাঁত, হরিণের চামড়া, ধনেশ পাখির ঠোঁট ইত্যাদি সংগ্রহ করে। আবার কাছিম, হরিণ এবং পাখি বিশেষতঃ জলচর ও পরিযায়ী পাখির মাংস হিসেব চাহিদা রয়েছে। এসব চাহিদের ফলে কিছু অসাধু মানুষ অবৈধ শিকার চালিয়ে যাচ্ছে। 

অবৈধ শিকার ও বাণিজ্যের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রাণী, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকা ছাড়াও পার্বত্য জেলাগুলোতে বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর মাংসের কেনাবেচা ও খাদ্যতালিকায় এদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, যার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। প্রচুর সংখ্যক কচ্ছপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী পাচারের সময় আটক করা হয় বিমানবন্দর, বেনাপোল ও অন্যান্য সীমান্তে। 

তক্ষক নিয়ে একটি গুজব প্রচলিত আছে যে, তক্ষক বিদেশে কোটি টাকায় বিক্রি করা যায়। এসব গুজবের ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে লোভে পড়ে নিরীহ তক্ষক শিকার করে, কেউ আবার কোটি টাকায় বিক্রি করার লোভে সেগুলো উচ্চমূল্যে শিকারীর কাছ থেকে কিনেও নিয়ে যায়। অথচ, এই পুরো ব্যাপারটিই ভিত্তিহীন, একটি গুজব। আদতে তক্ষকের কোনো বিশেষ গুণাবলি নেই, এবং এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, ফলে বিদেশে এর উচ্চমূল্যও নেই। কিন্তু কিছু অসাধু মানুষ এসব গুজব ছড়িয়ে মানূষকে বিভ্রান্ত করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর এভাবে মানুষের লোভের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে শত শত নিরীহ তক্ষক।