বন্যপ্রাণী শব্দটি ইংরেজি Wildlife থেকে উৎপন্ন হলেও Wildlife এর প্রকৃত বঙ্গানুবাদ হলো বন্যজীব বা বন্যপ্রাণ। প্রাণী, উদ্ভিদ ও অন্যান্য ক্ষুদ্রপ্রাণ মিলেই তো আমাদের জীবজগৎ। যেসকল প্রাণী গৃহপালিত নয় অর্থাৎ এদের জীবনধারণের জন্য মানুষের উপর নির্ভর করতে হয়না, তাদেরকে বন্যপ্রাণী বলা হয়। আর বন্যপ্রাণীর চারপাশের যে প্রাকৃতিক পরিবেশ, তার মধ্যেই সকল উদ্ভিদ ও অন্যান্য জীব অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সেই হিসেবে Wildlife এর মানে দাঁড়ালো বন্যপ্রাণ অথবা বন্যপ্রাণী ও তার পরিবেশ। 

বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকা সকল প্রাণীই বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমনঃ বাঘ, চিতা, ভোঁদর, ঢোঁড়াসাপ, মাছরাঙা এরা সবাই বন্যপ্রাণী। আবার বন্যপ্রাণী হলেই যে স্থলভূমিতে বাস করতে হবে এমন কথা নেই। এরা জলেও থাকতে পারে। যেমনঃ তিমি, শুশুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীরাও কিন্তু বন্যপ্রাণী।   

আবার মানুষের বাড়িতে বা খামারে যে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী পালন করা হয়, এরা কিন্তু বন্যপ্রাণী নয়। কারণ এরা মানুষের সাহায্য ছাড়া বাঁচতেই পারবে না। তবে ঘরে যে টিকটিকি দেখতে পাওয়া যায়, তারা কিন্তু আবার বন্যপ্রাণী। কারণ তাদের বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সাহায্যের দরকার হয়না। এজন্য এরা বন-জঙ্গলে না থাকলেও এরা বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। টিকটিকির মতো আরও অনেক প্রাণী মানুষের এত কাছাকাছি বসবাস করে যে এদেরকে বন্যপ্রাণী হিসেবে ভাবতে ইচ্ছা করে না আমাদের। যেমনঃ চড়ুই পাখি, জালালী কবুতর, ইঁদুর ইত্যাদি। এরা যতোই লোকালয়ের কাছাকাছি বসবাস করুক, মানুষের সাহায্য ছাড়াও এরা খাদ্য সংগ্রহ, প্রজনন ও বাসস্থান তৈরির ক্ষমতা রাখে। তাই এরাও বন্যপ্রাণী। 

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়াও বন্যপ্রাণীর কিন্তু অনেক ধরনের গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য, এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অনেক। বন্যপ্রাণী ও তার সাথে সম্পৃক্ত জীবসমূহের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জলাধারগুলো পরিশোধিত হয়, ফলে সেখানে মাছেরা বংশবিস্তার করতে পারে। বন্যপ্রাণী না থাকলে ময়লা পানির কারনে সব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেত নদী-নালা খাল-বিল থেকে। 

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকেও মানুষকে রক্ষা করে বন্যপ্রাণী।  একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ১৯৭০-৮০ সালের দিকে বাংলাদেশ বিদেশে প্রচুর ব্যাঙের পা রপ্তানি করতে শুরু করলো, কারণ বিদেশে ব্যাঙের পা রান্না করে খাওয়ার খুব চাহিদা ছিল। রপ্তানির জন্য ব্যাঙ শিকারের কারণে আমাদের দেশে ব্যাঙের সংখ্যা অনেক কমে গেল। আর ব্যাঙের প্রিয় খাদ্য কীট-পতঙ্গ। ফলে দেশে কীট-পতঙ্গের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল, আর তারা আমাদের সব ফসল খেয়ে ফেলতে লাগলো। কৃষকরা ফসল বাঁচাতে প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক বিষ ব্যবহার করা শুরু করলো। হিসেব করে দেখা গেলো, ব্যাঙের পা রপ্তানি করে বাংলাদেশ যে টাকা আয় করলো, তার থেকে বেশি টাকা কীটনাশক কিনতে খরচ হয়ে গেল। তাহলে ব্যাঙ শিকার করে লাভ হলো, নাকি উলটো ক্ষতিই হলো?

তারপর ধরো, আমাদের সুন্দরবনের বাঘ দেখতে প্রতিবছর অনেক পর্যটক সুন্দরবনে বেড়াতে আসে, এমনকি বিদেশ থেকেও অনেকে আসে। টাঙ্গুয়ার হাওরসহ অন্যান্য স্থানে অতিথি পাখি দেখতে ভীড় করে পর্যটকেরা। এরকম আরও অনেক বন্যপ্রাণী আছে, যাদের দেখতে পর্যটকেরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে আসে। এভাবে বাঘ, অতিথি পাখি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে। আমরা এখন যে মুরগী খাই, এটি কিন্তু অনেক বছর আগে বনমোরগকে জঙ্গল থেকে নিয়ে এসে গৃহপালিত করারই ফলে সম্ভব হয়েছে। এভাবে হাঁস, গরু, ছাগল এবই কিন্তু কোনো না কোনো বন্যপ্রানী থেকে আগত।  

চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় বন্যপ্রাণী ব্যবহার করা হয়। । বিভিন্ন ঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস থেকে সুন্দরবন সহ অন্যান্য বনগুলো আমাদেরকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। বন্যপ্রাণী না থাকলে কিন্তু এসব বনও বিলুপ্ত হয়ে যেত। বন বাঁচিয়ে রাখে প্রাণীকে, আর প্রাণী বাঁচিয়ে রাখে বনকে। বন্যপ্রাণী না থাকলে ফুলের পরাগায়ন হয়ে ফসল ফলবে না, ফল হবে না, উদ্ভিদের বীজ দুরদুরান্তে ছড়িয়ে পড়বে না। 

মানুষের হাজার বছরের শিল্প, সাহিত্য, সংস্ককৃতিতেও কিন্তু বন্যপ্রাণীর অবদান অনেক। ছোটবেলায় সবাই নিশ্চয় এই কবিতা পড়েছোঃ 

আয়রে আয় টিয়ে

নায়ে ভরা দিয়ে, 

না’ নিয়ে গেল বোয়াল মাছে, 

তাই না দেখে ভোঁদড় নাচে।

আরেকটু বড় হয়ে পড়েছো জীবনানন্দের কবিতাঃ

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শঙখচিল শালিকের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

বিভিন্ন দেশীয় রূপকথা যেমন ঠাকুরমা’র ঝুলিতে নিশ্চয় অনেক বাস্তব ও কাল্পনিক প্রাণীর কথা পড়েছো। এছাড়া প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদ, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল ইত্যাদি সাহিত্যে কাক, কোকিল, সাপসহ অনেক প্রাণীর কথা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়সহ প্রায় সকল সাহিত্যিকই বিভিন্ন প্রাণীর কথা লিখেছেন সাহিত্যের প্রয়োজনে। এমনকি বন্যপ্রাণীকে রূপক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গল্পে। যেমনঃ হাসান হাফিজুর রহমান রচিত একজোড়া পাখি, হাসান আজিজুল হক রচিত শকুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসে রচিত যুগলবন্দি ইত্যাদি। এভাবে যুগযুগ ধরে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অজস্র গল্প, কবিতা, উপন্যাস।  

এসকল কারণেই বন্যপ্রাণীকে বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না, সবাই মিলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। উপরের কারণগুলো ছাড়াও শতশত কারণ রয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের। সব কারণ লিখতে বসলে কয়েকশত পৃষ্ঠার বই হয়ে যাবে তবুও লেখা শেষ হবে না। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হলো ভালোবাসা। ভাল মানুষ যেমন একে অপরকে ভালবাসে, তার কষ্টে কষ্ট পায়, বিপদে সাহায্য করে, তেমনি তারা বন্যপ্রাণীদেরও ভালবাসে, তাদের দুঃখেও দুঃখ পায়, তাদের মৃত্যুতে কষ্ট পায়। মানুষসহ সকল প্রাণী মিলেই এই সুন্দর পৃথিবী, এখানে বেঁচে থাকার অধিকার সবারই আছে, মানুষ যেমন সুন্দর, বন্যপ্রাণীরাও সুন্দর। কোনো মানুষ বিপদে পড়লে আমরা যেমন সবাই মিলে সাহায্য করি, তেমনি বন্যপ্রাণীদের বিলুপ্তি রোধেও আমাদের সবাই মিলে এগিয়ে আসতে, তাদের সংরক্ষণের জন্য কাজ করতে হবে, তাদের ভালবাসতে হবে।