পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে অনেক সমৃদ্ধ। এ জীববৈচিত্র্য তথা বন্যপ্রাণী ও এদের আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, যুগোপযোগী নানা উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনা। বন্যপ্রাণীর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও এদের বংশগতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা এই নিবন্ধে এসকল উদ্যোগসমূহ নিয়ে আলোচনা করবো যাতে শিক্ষার্থীরা এসব উদ্যোগ নিয়ে জানতে পারে ও বিভিন্ন কার্যক্রমে নিজেদের যুক্ত করতে পারে।

6.1 সরকারি উদ্যোগঃ

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম শর্ত হলো আবাসস্থল রক্ষা করা। বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এই কার্যক্রমের নেতৃত্ব প্রদান করে থাকে। এ লক্ষ্যে সারাদেশে বন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল অফিস কাজ করে যাচ্ছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রম ও বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল (https://rb.gy/hvd83w) ও বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট (https://rb.gy/woy29r) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। 

বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কর্তৃক ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে ২২ টি সংরক্ষিত এলাকায় সহব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক রক্ষিত এলাকার ইকোট্যুরিজম খাত হতে আয়ের ৫০ ভাগ এবং গৌণ বা অকাষ্ঠল বনজ দ্রব্য (সিলভিকালচার অপারেশন, যেমন ডালপালা কাটা বা পাতলাকরণ, মৎস্য আহরণ, ইত্যাদি) হতে আয়ের ১০০ ভাগ, অপ্রধান বনজ দ্রব্য (সুন্দরবনের মাছ, মধু, গোলপাতা ইত্যাদি) হতে আয়ের ৫০ ভাগ অর্থ রক্ষিত এলাকা সহব্যবস্থাপনা কমিটিকে প্রদান করা হচ্ছে। 

বন্যপ্রাণীর প্রজনন ও বংশবিস্তার এবং শিক্ষা-গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ও গাজীপুরে দুটি সাফারী পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়াও, বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ খাতের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ পরিচালনা নিশ্চিতকল্পে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি এবং মানসম্মত গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনার লক্ষ্যে গাজীপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শেখ কামাল ওয়াইল্ডলাইফ সেন্টার।

বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা, ২০২১ অনুমোদনের মাধ্যমে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর দ্বন্দ্ব হ্রাস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিধিমালা অনুযায়ী বাঘ, হাতি, কুমির, ভাল্লুক, বা সাফারী পার্কে বিদ্যমান বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে কোন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করেন সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ৩,০০,০০০/- (তিন লক্ষ) টাকা; গুরুতর আহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনধিক ১,০০,০০০/-(এক লক্ষ) টাকা এবং সরকারি বনাঞ্চলের বাইরে লোকালয়ে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনধিক ৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার ) টাকা। 

সুন্দরবনের বাঘ আমাদের গর্ব। সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। সুন্দরবনে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাঘ জরিপ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের বাঘ জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গিয়েছে। বাঘ সংরক্ষণের লক্ষ্যে সুন্দরবন সংলগ্ন ৪৯ টি গ্রামে স্থানীয় জনগনকে সঙ্গে নিয়ে ভিটিআরটি (ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে যারা বন থেকে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ নিরাপদে বনে ফিরিয়ে দিয়ে সাহায্য করছে। পাশাপাশি ১৮৩ জন সিপিজি (কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ) সদস্য সুন্দরবন সুরক্ষায় কাজ করছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশেষ টহল ব্যবস্থা বা স্মার্ট পেট্রোলিং চালু করা হয়েছে। বাঘসহ সকল বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির জন্য সুন্দরবনে পুকুর খনন ও পুনঃখনন করা হয়েছে। 

তোমরা জানো স্থলভাগের সর্ববৃহৎ প্রাণী হাতি। বৃহৎ এই প্রাণীটি বর্তমানে মহাবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। হাতি মানুষ দ্বন্দ্ব বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের দেশে যেসব হাতি পাওয়া যায় সেগুলো এশীয় হাতি (Asian Elephant), এদের মধ্যে দেশের বনাঞ্চলের স্থানীয় হাতি, আবার ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা আন্তঃদেশীয় হাতিও আছে। পাশাপাশি রয়েছে পোষা হাতি। হাতি ও এর আবাসস্থল সুরক্ষায় ইতোমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে হাতি চলাচলের পথ ও করিডোর এবং ট্রান্সবাউন্ডারি করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছে। হাতির বিচরণ এলাকায় হাতি-মানুষ দ্বন্দ নিরসণে স্থানীয় জনগনকে সাথে নিয়ে ১২০টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। লোকালয়ে হাতি প্রবেশ বন্ধে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই এবং শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলায় বৈদ্যুতিক বেড়া বা সোলার ফেন্সিং স্থাপন করা হয়েছে। হাতি সমৃদ্ধ এলাকার বনাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য হাতির খাদ্য উপযোগী গাছের বাগান সৃজন করা হচ্ছে। হাতির সাথে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের লক্ষ্যে স্থানীয় জনসাধারণকে প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। পোষা হাতি দিয়ে রাস্তাঘাটে, বসতবাড়ীতে চাঁদা আদায় করতে দেখা যায়। এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ অবৈধ। কোনো ব্যাক্তি হাতি দিয়ে চাঁদা উঠালে নিকটস্থ বন বিভাগ বা থানায় জানাতে হবে।

শকুন আমাদের অতি পরিচিত একটি পাখি। শকুন প্রকৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃতির পরিছন্নতাকর্মী হিসেবে যাকে আমরা জানি সেই শকুনের সংখ্যা এশিয়াতে গত কয়েক দশকে আশংকাজনক হারে কমে গেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে মহাবিপন্ন এই প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে বন বিভাগ। শকুন সংরক্ষণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন পুনরুদ্ধার কমিটি (বিএনভিআরসি)’ গঠন করা হয়েছে। দেশের সুন্দরবন এবং সিলেট এলাকার শকুনের জন্য দুটি নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে সরকার, যা বিশ্বের একমাত্র সরকার অনুমোদিত শকুন নিরাপদ অঞ্চল। রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুনের নিরাপদ এলাকায় প্রতি মাসে শকুনের জন্য নিরাপদ খাবার দেওয়া হচ্ছে। শীতকালে কিছূ হিমালয়ী গ্রিফন প্রজাতির শকুন অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। অসুস্থ ও আহত শকুনদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দিনাজপুরের বীরগঞ্জের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আমরা কী জানি, মৃত প্রাণীর দেহ থেকে ক্ষতিকর জীবাণু খেয়ে সাবাড় করে দেয় শকুন? শকুন হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত গরুর মাংস খেয়ে হজম করতে পারে। শকুন অপয়া নয়, শকুন প্রকৃতির বন্ধু। শকুন বনে ও লোকালয়ের উচুঁ গাছে বসবাস করে। দেশে পুরোনো ও উচুঁ গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ব্যথানাশক ক্ষতিকারক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক এবং কিটোপ্রোফেন শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে ডাইক্লোফেনাক এবং কিটোপ্রোফেন ওষুধ দুটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শকুন সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালন করা হচ্ছে। 

আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে একসময় প্রচুর পরিমাণ শুশুক দেখা যেত। জলজ পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখাসহ প্রকৃতিতে এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু, নদীর ক্রমাগত পরিবর্তন, মাছ ধরার জালে আটকা পড়া, নৌযানের প্রোপেলারের আঘাত, পানি দূষণ, মানুষের সচেতনতার অভাব ইত্যাদি কারনে শুশুক বর্তমানে হুমকীর সম্মুখীন। শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন এর হুমকীগুলো চিহ্নিত করে এর সংরক্ষণেও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ছয়টি ডলফিন অভয়ারণ্যের সাথে সুন্দরবনের ডলফিনের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে আরো নতুন তিনটি অভয়ারণ্যসহ মোট নয়টি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ডলফিনের বিস্তার, বিশ্লেষণ এবং আবাসস্থল সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সকল তথ্যাবলী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এছাড়াও, হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সুন্দরবনের ডলফিন সংরক্ষণের জন্য ডলফিন কনজারভেশন দল গঠন করা হয়েছে। উল্লিখিত কার্যক্রম সমূহ সফলতার সাথে সম্পন্ন করার ফলে সুন্দরবনে ডলফিনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্য (ঢাংমারী, দুধমুখী ও চাঁদপাই) তে এ বৃদ্ধির হার ৫৫%, যা দেশের ডলফিন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করছে। তবে শুশুক বা ডলফিন বাচিঁয়ে রাখতে তোমাদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শুশুক যেহেতু পানি ছাড়া বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না তাই মাছের জালে ধরা পড়লে খুব দ্রুতই এদের পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। শুশুক এর তেল ব্যবহারে বাত-ব্যথা বা কোন রোগ বালাই উপশম হয় না। এগুলো কুসংস্কার। এগুলো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা তোমাদের দায়িত্ব। 

সুন্দরবনের করমজলে অবস্থিত বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে নোনা পানির কুমিরের প্রজনন কার্যক্রমের মাধ্যমে সুন্দরবনে কুমির এর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এই প্রজনন কেন্দ্রে লোনা পানির কুমিরের কৃত্রিম প্রজনন, লালন-পালন ও পরবর্তীতে প্রকৃতিতে অবমুক্তকরণের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মহাবিপন্ন প্রজাতির বড় কাইট্টা (Batagur baska) এর সংরক্ষণ ও প্রজনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং করমজলে ০২টি প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির স্যাটেলাইট ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে এদের সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, কাছিমের প্রজননভূমি চিহ্নিতকরণ, অবৈধ শিকার ও বাণিজ্য বন্ধে জনসচেতনতা তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া হলুদ পাহাড়ী কচ্ছপ (Elongated tortoise), শিলা কচ্ছপ (Asian giant tortoise) সংরক্ষণেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

আমাদের দেশে শীতকালে প্রচুর পরিমাণ অতিথি পাখির আনাগোনা দেখা যায়। অনেকেই এসব পাখিদের শিকার করে, সিলেটের অনেক হোটেলে এসব পাখির মাংস রান্না করে খাওয়া হয় যা আইনত দণ্ডণীয় অপরাধ। বুনো পাখির মাংশ থেকে মানবদেহে রোগ বালাই সংক্রমনের আশংকা থাকে। তবে বর্তমানে এসব পাখি সংরক্ষণে সরকারিভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তোমাদের হয়তো ধারণা আছে একসময় আমাদের দেশে এয়ারগান দিয়ে প্রচুর পাখি শিকার করা হতো। পাখিসহ সকল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের লক্ষ্যে এয়ারগান নিষিদ্ধ করে সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে। 

উল্লিখিত সংরক্ষণ কার্যক্রম ছাড়াও উল্লুক, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, শাপলা পাতা, হাঙ্গর সহ অন্যান্য সকল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।

6.1.1 বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা

দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘Bangladesh Wildlife (Preservation) Order 1973’ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে উক্ত আদেশকে “বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও সংশোধন) আইন, ১৯৭৪” এ রুপান্তর করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও সংশোধন) আইন, ১৯৭৪ কে রহিত করে নতুন “বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২” প্রণয়ন করা হয়। এই আইন দশটি অধ্যায় এবং ৫৪টি ধারায় বিভক্ত। আইনের সাথে চারটি তফসিল যুক্ত করা হয়েছে, তফসিলে বাংলাদেশের রক্ষিত বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজাতিসমূহের উল্লেখ রয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী, তফসিলে উল্লেখিত বন্যপ্রাণী সমূহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত ধরা, মারা, পরিবহন, শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’ এর অধীনে ৬টি বিধিমালা রয়েছে যা নিম্নরূপঃ 

এসকল আইন এবং বিধিমালা সমুহের সুষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমেই বন্যপ্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আইন ও বিধিমালার লিংক (https://rb.gy/gg6k4j)

6.1.2 বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত অপরাধ সমূহঃ

বিশ্বে অবৈধ পণ্যের বাজারের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বন্যপ্রাণী। বছরে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হয়, যার বড় অংশ বিত্তশালীদের শৌখিন চিড়িয়াখানা ও পার্কে আটকে রাখার জন্য কেনা হয়। এ ছাড়া চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বন্যপ্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ খাবার ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে ব্যাগ, বেল্ট, গৃহশয্যা ও উপহারের সামগ্রী এবং গয়না তৈরিতে বন্যপ্রাণীর চামড়া, দাঁত ও নখের বিপুল ব্যবহার আছে। গবেষণার তথ্যানুযায়ী দেশের মোট ২৮ জেলায় হটস্পট হিসেবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা চলে। এসব জেলা থেকে বন্যপ্রাণী ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় আনা হয়। ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে, খুলনায় স্থলপথে ও চট্টগ্রামে সমুদ্রপথে প্রাণী পাচার করা হয় পার্শবর্তী দেশসমূহে। 

জীবন্ত বন্যপ্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে। আর উড়োজাহাজ ও জাহাজযোগে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে প্রাণী পাচার করা হচ্ছে। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিষধর সাপ, তক্ষক, ছোট সরীসৃপ, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ প্রভৃতি বন্যপ্রাণী। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী অপরাধের পথ বা দিক পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এসকল অপরাধের বিভিন্ন চিত্রসমূহ নিন্মরূপঃ

  • মানুষ নিজের অজান্তেই বা না বুঝে অনেক ধরনের বন্যপ্রাণী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, যেমন অনেক সময় শালিক, চড়ুই, কাক, চিল, ময়না, টিয়া ইত্যাদি পাখি ধরে বা লালন-পালন করে এবং অনেক ক্ষেত্রে ঘরের টিকটিকি, দাড়াস সাপ, গুইসাপ, গিরগিটি, বেজি ইত্যাদি প্রাণী দেখলেই তাদেরকে মেরে ফেলে, যা বন্যপ্রাণী অপরাধের সামিল। 
  • পৃথিবীব্যাপী বন্যপ্রাণীর একটি রমরমা অবৈধ বাণিজ্য আছে। বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসার সাথে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিময় হয়। বাংলাদেশ থেকে বাঘ, বনরুই, বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ, ভাল্লুক, লজ্জাবতী বানর, তক্ষকসহ বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বা ট্রফি যেমন বাঘ-হরিণের চামড়া, বাঘের দাঁত, হাড়, হাতির দাঁত, সাপের বিষ, ইত্যাদির অবৈধ পথে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। 
  • বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাংলো বাড়ি, বড় বড় শিল্প কারখানা, রিসোর্ট, অবৈধ মিনি চিড়িয়াখানায় বন্যপ্রাণীদের বন্দি রেখে চিত্তবিনোদনের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ফলে বন্যপ্রাণীদের প্রজনন, বংশবিস্তার ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। 
  • বিভিন্ন হাট-বাজার, দোকানে বিক্রেতারা বন্যপ্রাণীদের খাঁচায় রেখে ক্রয়-বিক্রয় করার জন্য নিয়ে আসে। টিয়া, ঘুঘু, শালিক, ডাহুক, ময়নাসহ বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখি এবং অন্যান্য প্রাণী যেমন শিয়াল, বন বিড়াল, বেজী, বানর, এসকল হাট-বাজারে ক্রয়-বিক্রয় হয়। 
  • সমাজে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী নিয়ে নানা ধরণের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এদের মধ্যে পেঁচার ডাক, বিজোড় শালিক দেখলে যাত্রা ভঙ্গ, শকুনের আগমণ ইত্যাদি অশুভ লক্ষণ, হরিণের মাংস খেলে যাত্রা শুভ হয়, শিয়ালের তেল, বাদুড়ের মাংস, সাপের মাংসতে বাত ব্যথা ভালো হয়, কচ্ছপ, বনরুই এর মাংস খেলে পুরানো রোগ সারে ও মানুষ দীর্ঘায়ু হয় ইত্যাদি। এসকল কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের ফলে অকারণে বন্যপ্রাণীদের হত্যা করা হচ্ছে। 
  • সমাজে পিছিয়ে পড়া বা অসচেতন মানুষ কবিরাজি চিকিৎসায় বেশি বিশ্বাস করে। বিভিন্ন ধরনের টোটকা ঔষধ, তাবিজ-কবজ তৈরিতে বন্যপ্রাণীর চামড়া, তেল, মাংস, হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় যা বন্যপ্রাণী অপরাধ। 
  • পাহাড়ি বা সমতলের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী শিকার করে প্রোটিনের উৎস হিসেবে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে পাহাড়ি অঞ্চলের বন্যপ্রাণীরা ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। 
  • গ্রাম অঞ্চলে অনেকেই মেছো বিড়ালকে মেছোবাঘ নামে জানে, ফলে অনেকেই এই ধরণের বিড়ালগোত্রীয় প্রাণীদের বাঘের মত হিংস্র মনে করে। ফলে মানুষ এসব প্রাণী পেলেই এদের ওপর আক্রমণ করে হত্যা করে ফেলে। 
  • কিছুদিন আগে মৌলভিবাজারে শিয়াল মারার জন্য মৃত ছাগলে বিষ মিশিয়ে দেয় কিছু দুষ্ট লোক। উক্ত ছাগলের বিষাক্ত মাংস খেয়ে ১৩ টি শকুনের মৃত্যু হয়। এ ধরনের ঘটনা কোন ভাবেই কাম্য নয়। খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোন স্তরে বিষ প্রয়োগ করলে পুরো বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় নেমে আসে।
  • বন্যপ্রাণীর ট্রফি যেমন বন্যপ্রাণীর (বাঘ, অজগর সাপ, লজ্জাবতী বানর, গুঁইসাপ, চিতা বাঘ, মেছো বিড়াল, কুমির) চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বেল্ট, মানিব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতা, পার্স ইত্যাদি তৈরি করা হয়। হাতির দাঁত, বনরুই এর আঁইশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের অর্নামেন্টস, পোশাকের বোতাম ইত্যাদি তৈরি করা হয়। তাছাড়া অনেক বন্যপ্রাণীর মাংস চাইনিজ ফুড হিসাবে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাদ্য তালিকায় দেখা যায়। 
  • বর্তমানে বিভিন্ন নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, ইত্যাদিতে বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীকে আটক করে ব্যবহার করে প্রদর্শন করা হয়। যার ফলে দর্শক ও দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বন্যপ্রাণীদের লালন-পালনে উৎসাহিত হয়।
  • অনলাইনে বন্যপ্রাণীর ব্যবসা অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে বন্যপ্রাণীর অসাধু ব্যবসায়িরা এ মাধ্যমকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্সট্রাগ্রাম, হোয়াটসএ্যাপ, বিক্রয় ডট কম, দারাজ, ইমো ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে উল্যেখযোগ্য।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ধারা ৬(১) এ বলা হয়েছে, লাইসেন্স বা অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনো বন্যপ্রাণী শিকার ও সংগ্রহ করতে পারবেন না। আইনের ধারা ৬ মোতাবেক এই আইনের তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণীর মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব হতে উৎপন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও আইনের ধারা ৪১ এ উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা প্ররোচনা প্রদান করলে এবং উক্ত সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, উক্ত সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী উল্লিখিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দন্ডে দণ্ডিত হবেন। উক্তরূপ অপরাধে তিনি সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ আবারও করলে সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন বছরের করাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। 

6.1.3 বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দেশ। বাংলাদেশের বন, অভ্যন্তরীণ জলাভূমি এবং বঙ্গোপসাগরে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এসব বন্যপ্রাণীর অনেক প্রজাতিই পৃথিবীতে মহাবিপন্ন, বিপন্ন ও সংকটাপন্ন। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ মানবসৃষ্ট নানান কারণে এই বিপুল জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বন্যপ্রাণী সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহ ও আবাসস্থল বিনষ্ট। অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী শিকার ও আবাসস্থল বিনষ্টের ফলে অসংখ্য বন্যপ্রাণী আজ বিলুপ্তপ্রায়। বন্যপ্রাণী শিকার এবং হত্যা করে বন্যপ্রাণীর চামড়া, দাঁত, হাড়, এমনকি জীবন্ত বন্যপ্রাণীও বিদেশে পাচার করা হয়। এছাড়াও, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রণীত আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা না মেনে চলাও অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। এসব অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর ৩১ ধারা মোতাবেক ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট গঠন করা হয়। 

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বন্যপ্রাণী শিকার, মারা ও ক্রয়-বিক্রয় রোধকরণ, বন্যপ্রাণী অপরাধ এবং অপরাধী শনাক্তকরন, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনে সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা, গনসচেতনতা সৃষ্টি এবং দেশের বন্দর সমূহে (স্থল বন্দর, বিমান বন্দর, সমুদ্র বন্দর) বন্যপ্রাণীর পাচার রোধে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা-পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও কাস্টমস এর সাথে সমন্বয় করে কাজ করে থাকে। তাছাড়া অবৈধভাবে বন্যপ্রাণীর আমদানি-রপ্তানি প্রতিহত করতে বাংলাদেশ কাস্টমস হাউজের সহযোগিতায় এই ইউনিটটি বিভিন্ন বন্দরসমূহ বিশেষ করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বন্যপ্রাণী আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে টহল ও চেকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশন, প্রটোকল, চুক্তি ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবার জন্য বেশ কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থার সাথে এই ইউনিটটি সম্পৃক্ত। এ সকল সংস্থা সমূহের মধ্যে CITES, CBD, CMS, GTF, UNODC, INTERPOL, SAWEN, TRAFFIC, IUCN, ICITAP-American Embassy, US FOREST & WILDLIFE SERVICE, WCS, USAID উল্লেখযোগ্য। অত্র ইউনিটে নিয়োজিত কর্মকর্তাগণের মোবাইল নম্বর – ০১৯৯৯০০০০৯৫, ০১৭১৩০৭৬৬৮৩, ০১৯১৬০৯৫৬৪৩, ০১৭৪৭০৩৬২৩৭, ০১৬১১৭৮৬৫৩৬ (জাতীয় জরুরী সেবা নম্বর ৯৯৯ এর সাথে সংযুক্ত) মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত জরুরী সেবা দিয়ে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বছরে প্রায় ১০/১১ হাজার সিটিজেন এর বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধান করা হয়। অধিকন্তু ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজারের অধিক স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে; যাদের তথ্য ও সহযোগিতায় মাঠ পর্যায়ে উদ্ধার অভিযান এবং জনসচেতনমূলক কার্যক্রমে সহযোগিতা নেয়া হয়। সঠিক তথ্য প্রদানকরীকে অপরাধ উদঘাটনে (তথ্য প্রদানকারী) পুরস্কার ২০২০ বিধিমালার আলোকে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আর্থিক পুরস্কার প্রদান করা হয়। 

২০১৬ সালে এ ইউনিটে একটি ওয়াইল্ডলাইফ ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা হয়। ল্যাবটিতে বন্যপ্রাণী অপরাধে জড়িত আলামত বা ট্রফির নমুনা থেকে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ প্রয়োগের নিমিত্তে প্রজাতি চিহ্নিত করা হয় এবং এর ধারাবহিকতায় বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর DNA বারকোড ডেটাবেস তৈরীর লক্ষ্যে কাজ চলছে। 

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট কর্তৃক ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে জুলাই ২০১২ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত মোট ৪৫,৪৩৬ টি বন্যপ্রাণী (উভচর, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, পাখি) উদ্ধার করে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ১৪০৫ টি ট্রফি উদ্ধার এবং ১৩৯ টি মামলা দায়েরসহ ২০৮ জন অপরাধীকে জরিমানা ও কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।

6.1.4 বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট

ওয়ান হেলথ ধারণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সবশেষ কোভিড মহামারীর পর আমরা আনুধাবন করতে পেরেছি। বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত- বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ সংক্রামক রোগ প্রাণীদেহ থেকে উৎপত্তি হয়, পরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যেসব রোগ পশুপাখি হতে মানুষে এবং মানুষ হতে পশুপাখিতে সংক্রমিত হয়, তাদের জুনোটিক রোগ (Zoonotic Diseases) বলে।

চিত্রঃ জুনোটিক রোগের সংক্রমণ

চিত্রঃ ওয়ান হেলথ

মানুষের স্বাস্থ্য, মৎস্য বা প্রাণী স্বাস্থ্য কিংবা পরিবেশ-একটা আরেকটার উপর নির্ভরশীল। সবটা মিলিয়েই পৃথিবীর স্বাস্থ্য, মানুষের স্বাস্থ্য। তাই, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য One Health বা একক স্বাস্থ্যনীতির ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবং কৃষি ও শিল্পের প্রসারের কারণে বনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এসব কারণে জীবজন্তুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ বাড়ছে। বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ প্রোগ্রামের অন্যতম প্রধান অংশীদার হিসেবে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর ট্রান্স-ডিসিপ্লিনারি গবেষণা, যৌথ প্রাদুর্ভাবের তদন্ত বাস্তবায়নের জন্য ওয়ান হেলথের সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারদের সাথে সহযোগিতা করছে। জুনোটিক রোগের প্রাদুর্ভাব তদন্ত এবং প্রশিক্ষণসহ জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি, এবং অন্যান্য কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোথাও কোনো রোগাক্রান্ত প্রাণীর মৃতদেহ পাওয়া গেলে সাথে সাথে বন অধিদপ্তর, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট (আইইডিসিআর, হট লাইন নম্বর ১০৬৫৫), প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরকে বা নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জানাতে হবে।

6.1.5 বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে পুরস্কারসমূহঃ

বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমকে অনুপ্রাণীত করার লক্ষ্যে বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদান রাখা ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার প্রদানের নীতিমালা (সংশোধনী), ২০২১ অনুযায়ী ৭ টি শ্রেণিতে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। পুরস্কারের অর্থের পরিমাণ, ১ম পুরস্কার ১ লক্ষ টাকা, ২য় পুরস্কার পঁচাত্তর হাজার টাকা এবং ৩য় পুরস্কার পঞ্চাশ হাজার টাকা। 

একইভাবে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কার্যক্রমকে গতিশীল করা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত শিক্ষা, গবেষণা ও বিশেষ অবদানের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন’ প্রদান করা হয়ে থাকে। মোট তিনটি শ্রেণিতে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়, যথাঃ বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিবেদিত ব্যক্তি, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় নিবেদিত ব্যক্তি এবং বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান। ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন’ এর প্রতিটি শ্রেণিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুই ভরি স্বর্ণের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ নগদ টাকা এবং পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক ও সনদ পেয়ে থাকেন। 

বন্যপ্রাণী অপরাধকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার অপরাধ উদঘাটনে (তথ্য প্রদানকারী) পুরস্কার প্রদান বিধিমালা, ২০২০ প্রণয়ন করেছেন। এক্ষেত্রে বিধিমালায় উল্লিখিত শর্তসমুহ পূরণ করে বন্যপ্রাণী অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করলেই দেওয়া হচ্ছে অপরাধ উদঘাটনে (তথ্য প্রদানকারী) পুরস্কার। 

6.2 বেসরকারি ও অন্যান্য উদ্যোগ

বর্তমানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও নানান উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। ‘পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ উদ্যোগ’ এর মাধ্যমে মাটিরাঙ্গার পূর্বখেদার নিভৃত অরণ্যবেষ্টিত পিটাছড়ায় ২৩ একরের প্রাকৃতিক বন গড়ে তুলেছেন চট্টগ্রামের মাহফুজ রাসেল নামের এক তরুণ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে পিটাছড়ায় দেখা মেলে বিপন্ন হলুদ পাহাড়ি কাছিম যা চাকমা ভাষায় ‘পারবো ডুর’ নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীরা অনেক আগে থেকেই তাঁদের নিজ নিজ পাড়ায় পানির উৎসগুলোকে বাঁচানোর জন্য ছোট ছোট বনাঞ্চল সংরক্ষণ করেছেন যেগুলো পাড়াবন বা মৌজাবন (ইংরেজিতে Village Common Forest -VCF) নামে পরিচিত। এসব পাড়াবন পাহাড়ি বনের প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বন আচ্ছাদন ফিরে

আসার কারনে এখন ক্যম্পাসে হরিণ, শুকর, বনমোরগ, সজারুসহ অনেক জাতের সাপ, ব্যাঙ ও পাখির নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাসের বন।  

পাবনার বেড়া উপজেলার কৈটোলা গ্রামে সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে পাখিদের জন্য অভয়াশ্রম গড়েছেন আকাশ কলি দাশ। সেই জমিতে কোনো এক সময় গড়ে তোলা একটি মাটির ঘরেই থাকেন আকাশ। ৮৭ বছর বয়সী এই পাখিপ্রেমীকে সহযোগিতা করেন তার ছোট বোন ঝর্ণা দাশ (৭৩)। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী তিনি ছিলেন উপজেলার মাছখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শিক্ষকতার শুরুর দিকেই পাখিপ্রেমে পড়েন তিনি। নগরায়নের ফলে পাখিরা যখন আবাস হারাচ্ছে, তখন এদের নিরাপদে থাকার জন্য নিজের বসতভিটাই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে প্রকৃতি আর পাখি সংরক্ষণ করছেন তিনি। আকাশের সেই জন্মভিটাই এখন পাখিদের অভয়াশ্রম। 

ঝিনাইদহ জেলার জহির রায়হান পেশায় একজন রং মিস্ত্রী। পেশায় রং মিস্ত্রী হলেও ২০০২ সাল থেকে তিনি নিজ উদ্যোগে ঝিনাইদহ জেলাসহ পাশ্ববর্তী অন্যান্য জেলার পাখিসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, চোরা শিকারীদের হাত থেকে পাখি ও পরিযায়ী পাখি উদ্ধার, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণে কাজ করে চলেছেন।

6.3 জনসস্পৃক্ততা

বাংলাদেশের রক্ষিত এলাকাসমূহের ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় বন-নির্ভর জনগোষ্ঠী এবং সুশীল-সমাজের অংশগ্রহণে সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী রক্ষিত এলাকার ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় বন্যপ্রাণী শিকার এবং বনের সম্পদ অবৈধভাবে আহরণ উল্লেখযোগ্যহারে কমে যাচ্ছে, ফলে বনজ সম্পদ রক্ষিত হচ্ছে। সহ-ব্যবস্থাপনার ফলে রক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বন অপরাধ ও বনজসম্পদের পাচার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। একইসাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে বনে পর্যটকদের সংখ্যা। এসব রক্ষিত এলাকায় পর্যটন থেকে অর্জিত আয়ের ৫০% ল্যান্ডস্কেপ উন্নয়ন ও জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যয় করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সহযোগিতামূলক বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মাধ্যমে রক্ষিত এলাকা, পাহাড়ি, শাল ও উপকূলীয় এলাকা সংলগ্ন ৬০০ গ্রামের ৪০,০০০ বন-নির্ভর পরিবারকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে বন পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। 

দিনশেষে বন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেবলমাত্র বন অধিদপ্তরের তথা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বনপ্রাণী সংরক্ষণে জনগণের সচেতনতা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বনভূমি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সাধারণ জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। বন অধিদপ্তর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রায় সকল প্রকল্পের অধীনে সেমিনার সহ আলোচনা সভার উদ্যোগ নিয়েছে। ডলফিন সংরক্ষণে সচেতন করতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত হচ্ছে ডলফিন মেলা। এছাড়াও বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট অপরাধ দমন ও গণসচেতনতা সৃষ্টিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।