প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারনে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির দিকেও ধাবিত হচ্ছে। বন্যপ্রাণী যাতে হারিয়ে না যায়, পরিবেশের ভারসাম্য যাতে বজায় থাকে সেকারণে সকল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। পুরো পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। আমরা এই নিবন্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করবো।

1.1 আবাসস্থল সংরক্ষণ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধকরণ

বন্যপ্রাণী যেসব প্রাকৃতিক অঞ্চলে বসবাস করে, সেই আবাসস্থল রক্ষা করার মাধ্যমে প্রজাতিসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। আবাসস্থলকে বন্যপ্রাণীর বিচরণের জন্য উপযুক্ত রাখা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সবচেয়ে পুরনো ও কার্যকর কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কী করে আমরা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে পারি। এটি করার অনেক উপায় থাকতে পারে, যেমন – বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে মানুষের কার্যকলাপ সীমিত করে দেয়া, প্রাকৃতিক বনে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকা যাতে বন্যপ্রাণীর চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে। আবার কোন অঞ্চলকে রক্ষিত এলাকা গড়ে তোলার মাধ্যমে সহজেই আবাসস্থল সংরক্ষণ করা যায়। বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের প্রয়োজনীয় স্থান (যেমন: খাদ্য খোঁজার জায়গা, শিকারি থেকে লুকানোর জায়গা, প্রজননের জায়গা, পরিযায়ী প্রাণীর চলাচলের অঞ্চল) ও বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর হটস্পট চিহ্ণিত করে সেই স্থানগুলোকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে বন্যপ্রাণীর শিকার ও আহরণ বন্ধ করা আবাসস্থল সংরক্ষণের মূল কার্যক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলো প্রায়শই বন উজাড়, দূষণ বা নগর উন্নয়নের মতো মানুষের কার্যকলাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যায়। এসব আবাসস্থল পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় গাছপালা প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে দেশীয় প্রজাতির পুনঃপ্রবর্তন করা যেতে পারে। আবাসস্থল পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যই হল আবাসস্থলকে এমন ভাবে পুনরুদ্ধার করা যাতে এটি অতীত অবস্থার মত প্রজাতিসমূহের জন্য নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হিসেবে গৃহীত হয়।

অপরদিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষনের আরেকটি কৌশল হলো প্রাণীদের আবাসস্থলে কৃত্তিমভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। যেমন- ভৌত কাঠামোর সংযোজন, খাদ্য সম্পদের ব্যবস্থা করা, পুকুর বা তৃণভূমির মতো বৈশিষ্ট্য তৈরি করা। এই পদ্ধতি আবাসস্থল সমৃদ্ধিকরণ হিসেবে পরিচিত।

1.2 রক্ষিত এলাকাসমূহ

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী দেশে সরকার ঘোষিত সকল অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যান, কমিউনিটি কনজারভেশন এলাকা, সাফারী পার্ক, ইকোপার্ক, উদ্ভিদ উদ্যান, বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা জাতীয় ঐতিহ্য ও কুঞ্জবনকে রক্ষিত এলাকা বলা হয়। বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশে রক্ষিত এলাকার সংখ্যা (Terrestrial & Marine) ৫৩ টি এবং পরিমাণ ৮,১৭,৯৭১.৬১৩ হেক্টর। এর মাঝে রয়েছে ১৯টি জাতীয় উদ্যান, ২৫টি অভয়ারণ্য, ২টি বিশেষ জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এলাকা, ৪ টি ইকোপার্ক, ২টি সামুদ্রিক রক্ষিত এলাকা, ১টি উদ্ভিদ উদ্যান রয়েছে। তালিকা দেখা যাবে এই লিংক থেকে: https://shorturl.at/bdxJZ

মৎস্য অধীদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় নিঝুম দ্বীপ ও কক্সবাজার উপকূলের কিছু অংশকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুসারে ১৩টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (Ecologically Critical Area – ECA) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই লিংক থেকে তালিকা দেখা যাবে: https://shorturl.at/almO1

এসব রক্ষিত এলাকাসমূহ উদ্ভিদ, প্রাণীজগত এবং তাদের আবাসস্থল সহ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এই অঞ্চলগুলি জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও বিভিন্ন প্রজাতির বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য।

রক্ষিত এলাকাগুলি মানব ক্রিয়াকলাপ যেমন বন উজাড়, খনন এবং কৃষির বিরুদ্ধে একটি বাফার জোন হিসাবে কাজ করে যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই এসব অঞ্চলের জন্য সঠিক ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা দরকার। পরিবেশের জন্য গুরুত্বপুর্ণ জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ অঞ্চল এলাকা চিহ্নিত করে আমাদের আরো রক্ষিত এলাকা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

ছবি: বাংলাদেশের রক্ষিত এলাকাসমূহ (সূত্র: বন অধিদপ্তর)

1.3 বন্যপ্রাণীর করিডোর ও ফ্লাইওয়ে

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুসারে, রক্ষিত বা সংরক্ষিত বনের সীমানা সংলগ্ন কিন্তু বন্যপ্রাণী চলাচলের উপযোগী কোন এলাকাকে বন্যপ্রাণী করিডোর হিসেবে ঘোষণা দেয়ার বিধান রয়েছে। কোনো এলাকাকে বন্যপ্রাণী করিডোর ঘোষণার উদ্দেশ্য হলো উক্ত এলাকার যে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করা, এবং বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করা। এটি মূলত একটি ল্যান্ডস্কেপ জোন বা করিডোর।

অনেক সময় মানুষের অনুপ্রবেশের জন্য বনভূমি একাধিক খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যার কারণে বন্যপ্রাণীরা আলাদা হয়ে যায় ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে না। তখন পাশাপাশি অংশকে একটা রাস্তা/ব্রিজ/সেতু দিয়ে সংযুক্ত করা হয় যাতে বন্যপ্রাণীরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হাতির জন্য আন্ডারপাস বা ওভারপাস বানানো, বানরগোষ্ঠীয় প্রাণীদের জন্য বিভক্ত বনের দুই খন্ডের দুইটা গাছের সাথে দড়ি বেঁধে দেওয়া। এতে বন্যপ্রাণী কানেক্টিভিটি সৃষ্টি হয়। যেমন- সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্কের রোপ ক্যানোপি ব্রীজ, দোহাজারী – কক্সবাজার রেললাইনের দু’পাশে চুনাতি অভয়ারণ্যের হাতি চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ।

শীতকালে আমাদের দেশে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। এসব পাখি বাংলাদেশের জলাভূমি তাঁদের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে। যে ভৌগোলিক পথে পরিযায়ী পাখিরা প্রতি বছর একে দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়মিত ভাবে উড়ে যেতে থাকে, সেই উড়ন্ত পথকে ফ্লাইওয়ে (Flyway) বলা হয়। পৃথিবীতে মোট ৯ টি ফ্লাইওয়ে নেটওয়ার্ক রয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ দুইটি ফ্লাইওয়ে নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ইস্ট এশিয়ান – অস্ট্রেলেশিয়ান ফ্লাইওয়ে পার্টনারশিপের আওতায় বাংলাদেশের ৬টি এলাকাকে ফ্লাইওয়ে সাইট ঘোষণা করা হয়। এগুলো হলো: টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, সোনাদিয়া, নিঝুপ দ্বীপ ও গাঙগুরার চর।

ছবি: পরিযায়ী পাখির ফ্লাইওয়ে ম্যাপ

1.4 প্রজাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ

বিপদাপন্ন (Threatened) ও প্রায় বিপদাপন্ন (Near Threatened) প্রজাতিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো রক্ষায় নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর তফসিল ১ ও ২ এ রক্ষিত বন্যপ্রাণী এবং তফসিল ৪ এ রক্ষিত উদ্ভিদের তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। উক্ত আইনের আওতায় প্রণিত বিধিমালার আলোকে লাইসেন্স, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পারমিট ব্যতীত কোন বন্যপ্রাণী শিকার করা যাবে না। রক্ষিত বন্যপ্রাণী ঘোষণা বনাঞ্চল ও বনাঞ্চলের বাইরে সারাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ইন-সিটু সংরক্ষণ বলতে বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক আবাসস্থলের মধ্যে প্রজাতির সুরক্ষা করা বোঝায়। এই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক নিয়মে জীব প্রজাতি যেখানে জন্মে সেখানেই সংরক্ষণ করা হয়। এটি সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে, যেমন- বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ, জাতীয় উদ্যান এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপনের মাধ্যমে অর্জন করা হয়। ইন-সিটু সংরক্ষণের প্রাথমিক লক্ষ্য হল বন্যপ্রাণীদের তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বজায় রাখা এবং পুনরুদ্ধার করা। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর রক্ষার জন্য ৫৩টি রক্ষিত এলাকা রয়েছে, এছাড়াও ১টি বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা, ২ টি রামসার সাইট ইন-সিটু সংরক্ষণের উদাহরণ।

অন্যদিকে এক্স-সিটু সংরক্ষণ তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলের বাইরে জৈবিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের সাথে জড়িত। এর মধ্যে জুলজিক্যাল পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ওয়াইল্ডলাইফ সাফারি পার্ক এবং জিন ব্যাঙ্ক অন্তর্ভুক্ত। চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন এক্স-সিটু সংরক্ষনের সবচেয়ে প্রাচীনতম পদ্ধতি। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক এক্স-সিটু সংরক্ষণের উদাহরণ।

 

1.5 জিনগত বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ

জিনগত বৈচিত্র্য হলো একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাপ্ত জিনের সব রকমের পার্থক্য। আবার একটি প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। এই সব বৈশিষ্ট্য প্রজাতির টিকে থাকা, অভিযোজন এবং বিবর্তনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা এই জিনগত বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করেন। জেনেটিক বৈশিষ্টের এ সুরক্ষার ব্যবস্থা এক প্রকার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কৌশল হিসেবে পরিচিত।

বৈচিত্রপূর্ণ উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ও অমেরুদন্তী প্রাণীরা পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে ও বেঁচে থাকতে সক্ষম। তাই মানব কল্যাণে ব্যবহার এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই বৈচিত্র্য সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল দেশ তাদের জেনেটিক সম্পদসমূহ কোন নির্দিষ্ট জেনেটিক সম্পদের প্রকৃত পরিবেশে (in situ) এবং/বা কৃত্রিম পরিবেশ (ex situ) যেমন, জীন ব্যাংকে সংরক্ষণ শুরু করেছে।

বাংলাদেশে উদ্ভিদ, প্রাণী, মৎস্য, অণুজীব, কীটপতঙ্গ, অমেরুদণ্ডী প্রাণী, বনজ, ইত্যাদি জেনেটিক রিসোর্সেস সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র রয়েছে। একবার কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তাদের জিনপুল চিরতরে হারিয়ে যাবে। আমাদের দেশে বর্তমানে জাতীয় জিন ব্যাংক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফ্রোজেন জু (Frozen Zoo) রয়েছে।