বন্যপ্রাণী যে স্থানে বাস করে মূলত সেটিই তার আবাসস্থল। আমাদের দেশের প্রায় ২৩ লক্ষ হেক্টর বনভূমি রয়েছে যা দেশের মোট ভূমির ১৫.৫৮ শতাংশ। দেশের বনভূমির বেশিরভাগ অংশ জুড়েই রয়েছে পার্বত্য বনভূমি, সমতলীয় শালবন ও উপকূলীয় বনাঞ্চল। এ বনাঞ্চলসূহই দেশীয় বন্যপ্রাণীর প্রধান আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। এই অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নিয়ে আলোচনা করবো। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল দুই ধরণের হতে পারে –  ক. স্থলজ আবাসস্থল (Terrestrial Habitats) ও খ. জলজ আবাসস্থল (Aquatic Habitats)

2.1    স্থলজ আবাসস্থল

ভৌগলিক অবস্থান ও বনের চরিত্র অনুযায়ী বন্যপ্রাণীর বিভিন্ন রকমের স্থলজ আবাসস্থল আছে বাংলাদেশে। এই পার্বত্য বনভূমি ও সমতলীয় শালবন অঞ্চলই বাংলাদেশের স্থলভাগে বন্যপ্রাণীর মূল আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও স্থলজ আবাসস্থল হিসেবে তৃণভূমি, ফসলি জমি, বাঁশবন ও গ্রামীণ বন বা জঙ্গল উল্লেখযোগ্য।

2.1.1      পার্বত্য বনভূমি

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত ক্রান্তিয় পার্বত্য বন বা পাহাড়ি বন, যার বেশিরভাগ মিশ্র-চিরসবুজ বন যা ৬৮০,০০০ হেক্টর জমি জুড়ে বিস্তৃত। উত্তর-পূর্ব এলাকার বনগুলি বেশিরভাগই খণ্ডিত এবং এটি দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত বড় মিশ্র-চিরসবুজ বনে বিস্তৃত হয়েছে। এ বনের জলবায়ু মূলত আর্দ্র তাই বাংলাদেশের এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকাজুড়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ি বনাঞ্চল। উত্তর-পূর্ব এলাকার সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায়ও এই বনের বিস্তৃতি দেখা যায়।

এই বনে রয়েছে গর্জন (Dipterocarpus terbinatus), বৈলাম (Anisoptera scaphula), সিভিট (Swintonia floribunda), চাপালিশ (Artocarpus chaplasha), জারুল (Lagerstroemia speciosa), ডুমুর (Ficus auriculata), আমলকি (Phyllanthus emblica), ভাদি (Engelhardtia spicata), কালোজাম (Eugenia janbulana), নাগেশ্বর (Mesua ferrea), গোদা (Vitex heterophylla) সহ আরও অনেক জাতের বৃক্ষ।

বাংলাদেশের এই পার্বত্য বনে এশিয়ান হাতি (Elephas maximus), কালো ভাল্লুক (Ursus thibetanus), সূর্ষ ভাল্লুক (Helarctos malayanus) চশমাপরা হনুমান (Trachypithecus phayrei), উল্লুক (Hoolock hoolock), লজ্জাবতি বানর (Nycticebus bengalensis), পাতি শিয়াল (Canis aureus), বন কুকুর (Cuon alpinus) বনমোরগ (Gallus gallus), বনছাগল (Capricornis rubidus), সজারু (Hystrix brachyura), সাম্বার হরিণ (Rusa unicolor) সহ ইত্যাদি স্তন্যপায়ী; পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা সাপ গোলবাহার বা জালি অজগর (Python reticulatus) পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিষধর সাপ রাজ গোখরা (Ophiophagus hannah), এশিয়ার সবচেয়ে বড় কচ্ছপ শিলা কচ্ছপ (Manouria emys), তিন প্রজাতির গুইসাপ (Varanus spp),  তক্ষকসহ অনেক জাতের সরীসৃপ, নানা প্রজাতির ব্যাঙ, রাজ ধনেশ (Buceros bicornis), কাঠ ময়ূর(Polyplectron bicalcaratum), বনমোরগ (Gallus gallus), পাহাড়ি ময়না (Gracula religiosa) সহ নানান জাতের পাখি ইত্যাদি প্রাণীর দেখা মেলে। এই বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে – গন্ডার, ভাদি হাঁস (Asarcornis scutulata) সহ আরো অনেক প্রজাতির প্রাণী।

2.1.2    সমতলীয় শালবন

যে সব বনে বেশিরভাগ উদ্ভিদের পাতা শীতকালের শেষের দিকে ঝরে পড়ে, সেগুলই মূলত পত্রঝরা বা পর্ণমোচী  বলা বন হয়। এসব বন শাল-প্রধান (Shorea robusta) হওয়ায় এগুলোকে সমতলীয় শাল বনও বলা হয়। এই বন বাংলাদেশের মাঝামাঝি ও উত্তরের অপেক্ষাকৃত শুষ্ক অঞ্চলে ছড়ানো ছিটানো আছে। এই পর্ণমোচী বন প্রায় ১২০,০০০ হেক্টর, যা বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ০.৮১% অংশ জুড়ে রয়েছে। প্রধানত গাজীপুর, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুমিল্লা জেলায় পত্রঝরা বনাঞ্চল অবস্থিত। বেশিরভাগ পত্রঝরা বন টাঙ্গাইলের পূর্বাংশ, ময়মনসিংহের পূর্বাংশ ও পশ্চিমাংশে এবং গাজীপুর জেলার উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত। মধুপুরের গড় ও ভাওয়ালের গড় নামে পরিচিত শালবনের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ মাইল এবং প্রস্থ স্থান বিশেষে ৫-২৫ মাইল, মোট আয়তন প্রায় ৯০০ বর্গমাইল। উত্তরাঞ্চলের শালবন বরেন্দ্র বনাঞ্চল নামেও পরিচিত। এছাড়া কুমিল্লা জেলার লালমাই শালবন বিহার ও ময়নামতিতে প্রায় ২০০ হেক্টর এলাকায় পত্রঝরা বনাঞ্চল রয়েছে। অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও এসকল বনের বৈশিষ্ট্যগত তেমন পার্থক্য নেই। পত্রঝরা বনের মাটি সর্বত্রই প্রায় লালচে হলুদ। উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো বনের মাটি হালকা বাদামি বা বাদামি-লালচে। শীতকালে মাটি শুষ্ক থাকে কিন্তু বৃষ্টিপাতের পর কাদায় পরিনত হয়। এ বনের মাটি অনেকটা মধুপুর বনের মাটির মতো।

এ বনাঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদসমূহ হল-শাল (Shorea robusta), বেল (Aegle marmelos), নিম (Azadirachta indica), সোনালু (Cassia fistula), বাবলা (Acacia nilotica)। এই পর্ণমোচী বনে রয়েছে তক্ষক (Gekko gecko), গুইসাপ (Varanus bengalensis), রক্তচোষা (Calotes versicolor), শঙ্খিনী (Bungarus fasciatus) এবং গোখরা (Naja naja), ২০০-২৫০ প্রজাতির পাখি এবং স্তন্যপায়ীদের মধ্যে রয়েছে রেসাস বানর (Macaca mulatta), লালবুক হনুমান (Trachypithecus pileatus), গন্ধগোকুল (Viverra zibetha), কাঠবিড়ালী ও বাদুর ইত্যাদি। তবে একটা সময়ে শালবনে হাতি, বাঘ ও হরিন ছিল কিন্তু সেসব এখন আর নেই।

2.1.3    অন্যান্য স্থলজ আবাসস্থল

তোমরা আগেই জেনেছ পার্বত্য ও সমতলভূমির বন ছাড়াও স্থলজ আবাসস্থল হিসেবে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক অঞ্চল যেমন – তৃণভূমি, বাঁশবন, ও গ্রামীণ বন বা জঙ্গল রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বসবাস করে থাকে।

2.1.3.1     তৃণভূমি

তৃণভূমি এমন অঞ্চল যেখানে গাছপালার মধ্যে ঘাসের আধিপত্য থাকে। তবে শর এবং নলখাগড়া ও দেখা যায়। সঙ্গে নানা অনুপাতে ক্লোভার (ত্রিপত্রবিশেষ) এর মতো শিম জাতীয় গুল্ম এবং অন্যান্য ভেষজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ তৃণভূমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগ অবশিষ্ট তৃণভূমি অঞ্চলগুলি খণ্ডিত ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চাষাবাদের জন্য প্রচুর ব্যবহৃত হওয়ার এবং বছরে তিনবার পর্যন্ত ফসল ফলানো হয় ঘাসজমিতে। অধিকন্তু, উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের খাগড়ার জমিগুলি কাগজ উৎপাদনের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তা ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নদী ও হ্রদের আশেপাশের উঁচু তৃণভূমিও বাংলাদেশে বিদ্যমান ছিলো। জলাশয় সংলগ্ন এইসব তৃণভূমিতে ইকরা, হোগলা, নল-খাগড়া, উলু প্রভৃতি উদ্ভিদের এর আধিপত্য ছিল। তৃণভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির তৃণভোজী বন্যপ্রাণীরা চরে বেড়াতো একসময়, এবং জলাশয় সংলগ্ন তৃণভূমিতে মাছরাঙা, পানকৌড়ি, ডাহুক, জল-ময়ূর সহ আরো অনেক জাতের পাখি বাসা তৈরী করে।

বাংলাদেশের নদী কিংবা জলাভূমিকে কেন্দ্র করে খাগড়া-আধিক্য তৃণভূমি একসময় ছিল নানা প্রানীর বিচরণ ক্ষেত্র। এসব তৃণভূমিতে বিচরিত যেসব প্রাণী হারিয়ে গেছে বলে ধরা হয় সেগুলির মধ্য জাভান গন্ডার (Rhinoceros sondaicus), বুনো মহিষ  (Bubalus arnee), বারশিঙ্গা (Rucervus duvaucelii), কৃঞ্চসার (Antilope cervicapra) এবং বাংলার ফ্লোরিকান (Houbaropsis bengalensis) উল্লেখযোগ্য।

2.1.3.2     বাঁশবন

বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক বাঁশবাগানগুলোর পাশাপাশি সারাদেশই বিভিন্ন গ্রামের আনাচে-কানাচে প্রচুর বাঁশবাগান বা বাঁশঝাড় দেখা যায়। গ্রামের মানুষ ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু-পাখির ঘর, ক্ষেতের বেড়া, নদী পারা পারে সাঁকো তৈরি ছাড়াও গৃহস্থালীয় নানা কাজে ও বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে বাঁশ ব্যবহার করে। এসব বাঁশঝাড় বক-জাতীয় পাখিদের কলোনী (একসাথে অনেক পাখি বাসা তৈরী করে) ছাড়াও দোয়েল, শালিক, কাঠবিড়ালী সহ নানা বন্যপ্রাণী বাস করে ।

2.1.3.3     গ্রামীণ বন বা জঙ্গল

তথাকথিত ঘন বনাঞ্চল বাদেও লোকালয়ের মাঝে বা গ্রামীণ এলাকায় বাড়ির আঙিনা ও তার আশে পাশে স্থানীয় ফলদ ও অন্যান্য গাছপালা মিলে গৃহস্থালি বন তৈরী হয়। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনগুলো স্থানীয় বন্যপ্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, পাতিশিয়াল, কাঠবেড়ালি, সজারু, সাপ ও নানা জাতের পাখি ( জাতীয় পাখি দোয়েল, বুলবুলি, ঘুঘু, শালিক) এই ছোটো ছোটো বাগান সদৃশ বনে বাসা তৈরী করে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও বন্যপ্রাণীর সাথে নিয়মিত সংযোগের জন্য এই ধরনের বনাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ অনেক। একসময় গ্রামীন বনের গাছেগাছে নানান জাতের পাখির বাসা ঝুলতে দেখা যেত। বর্তমানে নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিকাজ সম্প্রসারণের জন্য এই বনাঞ্চল আশংকাজনক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

2.2    জলজ আবাসস্থল

এবার আসা যাক জলজ আবাসস্থল নিয়ে। বাংলাদেশের জলজ আবাসস্থলকে মূলত তিনভাগে বিভক্ত করা যায় – মিঠাপানির আবাসস্থল, উপকূলীয় আবাসস্থল ও সামুদ্রিক আবাসস্থল – বঙ্গোপসাগর ।

2.2.1    মিঠাপানির আবাসস্থল

হিমালয়ের পাদদেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদ-নদী নিয়ে গঠিত আমাদের এই বাংলাদেশ। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনাসহ অন্যান্য নদীগুলি একটি বিস্তৃত জালিকা তৈরি করে বাংলাদেশকে জড়িয়ে রেখেছে। এই জলপথ জলজ জীবজগত ও মানুষ উভয়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। নদীর এ বিস্তৃত অঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশ জলাভূমি, হ্রদ, হাওর, বাওর এবং বিল দিয়ে ঘেরা। এই মিঠাপানির জলাশয়ের পানি মানুষের প্রয়োজন ছাড়াও অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীর খাবার, মাছের আবাসস্থল এবং কৃষি জমির সেচের পানির অন্যতম উৎস। মিঠাপানির জলাশয় বন্যা থেকে রক্ষা পেতেও গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করে। মিঠাপানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো নদীর চরাঞ্চল। এ চরাঞ্চলগুলোতে পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, বক, কাঁকড়া, সাপ, শেয়াল, ব্যাঙ, ইঁদুর ও কচ্ছপ দেখা যায়।

বাংলাদেশর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিম্নভূমিতে মিঠাপানির যে আবাসস্থল অবস্থিত তা আমরা জলাবন হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। এই ধরনের বনে বন্যা-সহনশীল চিরহরিৎ গাছ রয়েছে যা মিঠাপানির জলাভূমির ১০-১২ মিটার উচ্চতার বন্যার পানিতে সহনশীল। বাংলাদেশের ঊত্তর-পূর্ব দিকে বিভিন্ন সোয়াম্প ফরেস্টের মধ্যে রাতারগুল জলজবন অন্যতম।  মিঠাপানির জলাভূমির গাছগুলির বিস্তৃত শিকড় ব্যবস্থার কারণে এটা ঘনিষ্ঠ ছাউনির মত তৈরি করে। এই বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি গুলো হলো: নোনা হিজল (Barringtonia asiatica), করচ (Pongammia pinnata) নল খাগড়া (Phragmites karka), হরগজা (Acanthus ilicifolius)। এই সকল গাছের বীজ মূলত জলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং কাদার সাথে যুক্ত হয়ে পুনরুত্থিত হয়। এই বনের বন্যপ্রাণী হলো: বানর, কাঠবিড়ালী, ভোঁদড়, সাপ ও পাখি।

মিঠাপানির জলাশয় হিসেবে টাংগুয়ার হাওর, হাইল হাওর ও বাইক্কা বিলের নাম উল্লেখযোগ্য। এ জলাশয়গুলি আন্তর্জাতিক ফ্লাইওয়ে সাইটের অন্তর্গত, যা দেশী ও  পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব জলাশয়ে শীতকালের পাশাপাশি সারা বছরই পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজহাঁস, দাগী রাজহাঁস, রাজ সরালি, পাতি সরালি, ঝুঁটি হাঁস, চকাচকি, লেজা হাঁস, খুন্তে হাঁস, বালি হাঁস, তিলি হাঁস, লালশির, নীলশির, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, ভূতি হাঁস, স্মিট হাঁস, পাতি মারগেজার, ওমচা, পাপিয়া, খঞ্জন, ফুটকি, সাহেলি, চ্যাগা, গুলিন্দা, সারস, গ্রিধিনি, মানিকজোড়, এশীয় শামোকখোল, নীলকণ্ঠ ইত্যাদি।

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম জলমহালগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত এ হাওর স্থানীয় লোকজনের কাছে নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামে পরিচিত। হিজল-করচ বন ও নলখাগড়া বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০,০০০ একর। প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ এ হাওর পাখি, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৬৭ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়; যার মোট সংখ্যা ৬৫ হাজারের বেশি। জলচর পাখি জরিপের গণনা অনুযায়ী, প্রতি বছর শুধু শীতকালেই পৃথিবীর বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে প্রায় ৮৪ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিরা এ হাওরকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়। ২০২৩ সালে পরিচালিত জলচর পাখিশুমারী অনুযায়ী, ৬৫ প্রজাতির ৫৪,১৮০টি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। এ হাওরে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ও বিপদাপন্ন পাখি প্রজাতির মধ্যে বৈকাল-তিলিহাঁস (Baikal teal, Sibirionetta formosa) এর দেখা মেলে। বাংলাদেশে ‘মহাবিপন্ন’ এবং বিশ্বে ‘বিপন্ন’ প্রাণী হিসেবে বিবেচিত পালাসি-কুরাঈগলের (Pallas’s fish eagle, Haliaeetus leucoryphus) দেখা মেলে এ হাওরের হিজল-করচ গাছে। এরা শীত মৌসুমে এদেশে আসে এবং প্রজনন শেষে বর্ষা মৌসুমে উত্তর মেরুর দিকে চলে যায়।

হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর। এই হাওর মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া ও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার জুড়ে বিস্তৃত। হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। হাকালুকি হাওরে ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। প্রায় সারাবছরই বিল গুলোতে পানি থাকে। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে উঠে গোটা এলাকা। এ হাওরে বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন বেয়ারের-ভূতিহাঁস (Baer’s pochard; Aythya baeri). সংকটাপন্ন পাতি-ভূতিহাঁস (Common pochard; Aythya ferina), প্রায়-সংকটাপন্ন মরচেরং-ভূতিহাঁস (Red-crested pochard; Netta rufina) ইত্যাদি পাখি প্রজাতির দেখা মেলে।


এছাড়া হাইল হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বেশ কিছু অংশ জুড়ে অবস্থিত একটি বৃহদায়তন জলাভূমি। এতে রয়েছে ১৪টি বিল এবং পানি নিষ্কাশনের ১৩টি নালা। তন্মধ্যে বাইক্কা বিলে প্রতিবছর শীত মৌসুমে প্রচুর পরিযায়ী পাখির সমাগম ঘটে। ২০১১ সালে নতুন ৪টি পরিযায়ী পাখির দেখা মিলেছে এ বিলের চারপাশের বনে; সেগুলো হলোঃ বড়ঠুটি- নলফুটকি, উদয়ী-নলফুটকি, বৈকাল-ঝাড়ফুটকি ও সাইক্সের-ফুটকি।

2.2.2    উপকূলীয় আবাসস্থল

বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বরাবর একটি বিস্তৃত উপকূলরেখা রয়েছে, এই সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘতম  প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্রের ধারক। সুন্দরবন, মোহনা অঞ্চল ও গভীর সমুদ্রে বিচিত্র জীবজগতের অস্তিত্ব রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই রামসার সাইটটি অন বেঙ্গল  টাইগার সহ অসংখ্য প্রজাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। জোয়ারের জলপথ, কাদা এবং অসংখ্য খালের জটিল জালিকা সুন্দরবনকে জীবজগতের এক অনন্য আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত করেছে।

2.2.2.1     সুন্দরবন

বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকার জোয়ার-ভাটাযুক্ত বনকে বাদা বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন বলা হয়। এ বনের মাটি প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। পুরো সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এ বনের শতকরা ৬০ ভাগ বাংলাদেশে ও বাকি ৪০ ভাগ ভারতে অবস্থিত। বাংলাদেশের অংশ সাতক্ষীরা,খুলনা,বাগেরহাট,বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূল অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর ভিতর দিয়ে হাড়িভাঙা, রায়মঙ্গল, মালঞ্চ, শিবসা, পশুর ও বলেশ্বর নদী প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অংশের পরিমান ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার। কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ায় সুন্দবনের অনুরূপ একটি বন আছে যে বন “চকোরিয়া সুন্দরবন” নামে পরিচিত। সুন্দরবন ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হলেও সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়াতে এর জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ ও আর্দ্র। এখানে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০ সেন্টিমিটার। অনেক নদী, খাল জালের মতো ছড়িয়ে থাকার কারনে এটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়েছে। পলি ও বেলে মাটির সাথে হিউমাস মিশ্রিত ভেজা মাটিই এ বনের মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনের মাটি লবণাক্ত। এর উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকের উদ্ভিদের ভিতর কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

এ বনাঞ্চলের প্রধান কিছু উদ্ভিদ হল-সুন্দরী (Heritiera fomes), গেওয়া (Excoecaria agallocha), গোলপাতা (Nipa fruticans), পশুর (Carapa moluccensis), বাইন্ (Avicennia officinalis), গরান্ (Ceriops decandra), কেওড়া (Sonneratia apetala) ইত্যাদি। বাদা বন তথা ম্যানগ্রোভ বনে কাঁকড়া, চিংড়ি সহ নানা জাতের অমেরুদন্ডী প্রাণী ছাড়াও প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ, সবুজ ব্যাঙ (Euphlyctis hexadactylus) , সোনা ব্যাঙ (Hoplobatrachus tigerinus) সহ ১০ প্রজাতির উভচর, অজগর (Python molurus), গুইসাপ (Varanus salvator), কুমির(Crocodylus porosus), কাছিম (Nilssonia hurum) , রাজ গোখরা (Ophiophagus hannah )সহ প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, কালামুখ-প্যারাপাখি বা Masked Finfoot (Heliopais personatus), শঙ্খ চিল বা  Brahminy kite (Haliastur indus), White-bellied Sea Eagle (Haliaeetus leucogaster), Mangrove Pitta (Pitta megarhyncha) সহ ৩০০ অধিক প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এছাড়া স্তন্যপায়ীদের মধ্য বাঘ (Panthera tigris), চিত্রা হরিণ (Axis axis), বন্যশুকর (Sus scrofa), ভোঁদড় (Aonyx cinereus) ও শুশুক(Platanista gangetica) উল্লেখযোগ্য ।

2.2.2.2     উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনায়ন

নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাতে বিগত পাঁচ দশক যাবত উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনায়ন প্রচেষ্টা চলছে। উপকূলীয় এলাকায় জেগে উঠা চরভূমিতে ১৯৬৫ সাল থেকে এ বন সৃষ্টি করা হচ্ছে। একে প্যারাবনও বলা হয়। প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনের মত এ বন জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয়। সুন্দরবন ও উপকূলীয় বনায়নের ফলে সৃষ্ট বনাঞ্চল প্রায়শই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা হতে এ এলাকার মানুষ ও প্রাণীদের সুরক্ষা প্রদান করে। উপকূলীয় চরাঞ্চলে এ যাবৎ ২ হাজার ৫ শত ২১ বর্গ কি.মি. চর বনায়ন করা হয়েছে। এই বনগুলোতে উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কেওড়া, বাইন, গোলপাতা, ছৈলা ইত্যাদি। বন্যপ্রাণীর মধ্যে সচরাচর হরিণ, মেছোবাঘ, শিয়াল ইত্যাদি দেখা যায়। কালালেজ জৌরালী, দেশি গাঙচষা, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রাপাখ মাছরাঙা ইত্যাদি পাখির আবাসস্থল হিসাবে এসকল বনাঞ্চল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন মৎস্য ভান্ডারেরও একটি বিরাট উৎস। এখানে ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। উপকূলীয় এসব অঞ্চলে ছোট-বড় নানা চর ও দ্বীপাঞ্চল রয়েছে। এই চরগুলো নানা জলচর ও পরিযায়ী পাখির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। বিপন্ন দেশি গাঙচষা (Indian Skimmer), বাদামী মাথা গাংচিল (Brown-headed Gull) ও ধূসর রাজহাঁসের দেখা পাওয়া যায় এই চরগুলোতে।

2.2.2.3     সেইন্ট মার্টিন’স দ্বীপ

বাংলাদেশের সেইন্ট মার্টিন’স দ্বীপে (নারিকেল জিনজিরা নামে পরিচিত) প্রবাল-সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক আবাসস্থলের দেখা মেলে। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ অংশে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা থেকে ৯ কিমি দক্ষিণে গড়ে ওঠা একটি ছোট দ্বীপ। এই অঞ্চলে বসবাসরত জলজ প্রাণীরা অনেকাংশে বৈচিত্র্যময় এবং পর্যটক ও গবেষকদের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে। সেন্ট মার্টিন’স প্রবাল (প্রবাল সৃষ্ট চুনাপাথর), ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট কোকুইনা স্তর দ্বারা গঠিত। অত্যন্ত প্রবেশ্য (permeable) এবং রন্ধ্রযুক্ত (porous) হওয়ার জন্য ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর যেখানে পলল স্তরের নিচে সঞ্চিত হয় সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ জলস্তরের (aquifer) সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক (Recent) সামুদ্রিক বালি এবং ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর স্বাদু পানির প্রধান উৎস। সমস্ত দ্বীপ জুড়ে ভাটার পানি স্তরের অত্যন্ত কাছাকাছি ক্ষুদ্র খাড়িসমূহে বিভিন্ন ধরনের জীবিত ছোট ছোট প্রবাল গোষ্ঠী দেখা যায়। দ্বীপের চারপাশে অগভীর সমুদ্রেও এদের দেখা যায়। প্রধানত সৈকত শিলা (beach rock) জমে থাকা পাথরে এবং চুনযুক্ত বেলেপাথরে বেড়ে ওঠে। মৃত প্রবাল গোষ্ঠীগুলি ক্ষুদ্র জলমগ্ন নিম্নভূমিতে জোয়ারভাটা উভয় সময়েই দেখা যায়। এদের কিছু কিছু ভাটার সময়ের পানি স্তরের চেয়ে প্রায় ৩.৫০ মিটার উপরেও দেখা যায়।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে পৃথিবীর মধ্যেই অনন্য। সেখানে স্বচ্ছ পানির কারণে প্রবাল জন্ম নেয়। সাধারণত সামুদ্রিক দ্বীপে জলরাশির তাপমাত্রা, পানিতে লবণের পরিমাণ, বালুকণার পরিমাণ, পানির অম্লতা, ঢেউয়ের তীব্রতা, দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রবালের জন্মানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।  তবে ধীরে ধীরে এই নিয়ামকগুলোর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, আবাসিক হোটেলগুলোর দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যটকদের ব্যবহৃত সামগ্রী সমুদ্রের পানিতে নিক্ষেপ, পাথর উত্তোলন, প্রবাল উত্তোলন ও উপকূলীয় এলাকায় মাছ ধরার জালের যত্রতত্র ব্যবহারের কারনে সামুদ্রিক এই দ্বীপের বিভিন্ন নিয়ামক পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন বেশ কয়েক প্রজাতির কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র। সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসতে শুরু করে। তবে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পর্যটকের উপস্থিতি ও দূষণের কারণে কচ্ছপের নিরাপদ প্রজননক্ষেত্রটি যাতে ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু প্রজনন ক্ষেত্রই নয়, অনিয়ন্ত্রিত ও অতিরিক্ত পর্যটকের আনাগোনার কারণে দ্বীপের প্রবাল ধ্বংস হচ্ছে, ভূমি, পানি ও বায়ু  দূষিত হয়ে পড়ছে, । এ সকল ব্যাপারে আমাদের সকলকেই সচেতন থাকা প্রয়োজন যাতে কোনভাবে আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিনষ্ট না হয়।

2.2.2.4     অন্যান্য দ্বীপসমূহ

বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ রয়েছে। এইসকম দ্বীপ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক স্থান হিসাবে বিবেচিত। এইসবের মধ্যে অন্যতম দ্বীপগুলো হলো: দুবলার চর যা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শুটিকি পল্লী হিসেবে পরিচিত, বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপ। তন্মধ্যে সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপ আন্তর্জাতিক ফ্লাইওয়ে সাইটের অন্তর্ভুক্ত।

সোনাদিয়া দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের উপকূল সংলগ্ন এ দ্বীপটি নানা ধরণের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। সোনাদিয়ার প্যারাবনে প্রায় ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ২৭ প্রজাতির পাখির দেখা মিলে। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এ দ্বীপেই দেখা মেলে বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন পাখি চামচঠুঁটো বাটান (Calidris pygmaea) । শীতকালে এই দ্বীপে মহাবিপন্ন এ পাখি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। কেবল সামুদ্রিক বা পরিযায়ী পাখিই নয়, দ্বীপের উপকূল ১৯ প্রজাতির চিংড়ি, লবস্টার, লাল কাঁকড়া, ১৪ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, ডলফিন আর নানা প্রজাতির কচ্ছপের আবাসস্থল। দ্বীপের সমুদ্র উপকূলে শীতকালে হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ডিম পাড়তে আসে অসংখ্য মা-কচ্ছপ।

অপরদিকে নিঝুম দ্বীপ গঙ্গা- ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা নদী মোহনা মুখে অবস্থিত একটি ছোট্ট দ্বীপ যা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত। নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিলো চর-ওসমান। তবে, এটি ইছামতীর চর নামেও পরিচিত ছিল। শীতকালে, বিশেষত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত প্রায় ১০,০০০-২০,০০০টি পরিযায়ী পাখির আনাগোনা থাকে এ এলাকা জুড়ে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন কিছু প্রজাতির পাখিরও দেখা মেলে এখানে। সোনাদিয়ার মতো এই নিঝুম দ্বীপেও বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান (Calidris pygmaea) এর দেখা মেলে, আর মেলে সংকটাপন্ন দেশী গাঙচষা (Indian Skimmer; Rynchops albicollis) ।

   

2.2.3    সামুদ্রিক আবাসস্থল

বাংলাদেশের সামুদ্রিক আবাসস্থল হিসেবে আমরা মোহনা, অগভীর মহীসোপান ও গভীর সমুদ্রের অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করবো।

2.2.3.1     মোহনা অঞ্চল

মিঠাপানির নদ-নদী ও সাগরের লোনাপানি যে এলাকায় মিলিত হয়, সেই অঞ্চলই আসলে মোহনা হিসেবে পরিচিত। সমুদ্র, স্থলভূমি ও স্বাদুপানির সমন্বয়ে গঠিত বড় নদীর স্রোতমুখে স্বাদুপানি ও সামুদ্রিক পরিবেশের মধ্যে অনন্য বৈশিষ্টের একটি অন্তবর্তী এলাকা গঠিত হয়। সমুদ্র ও স্বাদুপানির অনেক জীব এখানে জীবনচক্রের একটি বিশেষ ধাপ অতিবাহিত করে। একটি মোহনার বৈশিষ্ট্য এতই গতিময় যে, সেখানে মাসে, দিনে এমনকি প্রতি ঘণ্টায়ও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এসব পরিবর্তন পরিযায়ী জীবের ও তাদের জীবনচক্রের ওপর, এমনকি সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দাদের শারীরবৃত্তের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের সমুদ্র ঊপকূল একটি জটিল মোহনা প্রণালীর জালিকা বিন্যাসে চিহ্নিত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কর্ণফুলি প্রভৃতি বড় বড় নদী প্রশস্ত মোহনা সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। অল্প কয়েক দশক আগেও এখানকার মোহনাগুলি মাছ ও বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ নানা জলজ প্রাণীতে যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু অতি আহরণের ফলে তা এখন বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।

2.2.3.2     অগভীর মহীসোপান

মহীসোপান হলো সমুদ্রতলের অংশ যেখানে পানির গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০ মিটার। মহীসোপানের উপরের অগভীর পানি গভীর ও সমুদ্রের পানি থেকে পৃথক হয়ে থাকে। উপকূলীয় নদীসমূহের প্রচুর দ্রবীভূত পুষ্টি উপাদান এই অগভীর পানিতে এসে মিশে যায়। এতে পলির পরিমাণ উচ্চমাত্রায় থাকে বলে মাঝ সমুদ্রের পানির চেয়ে এ পানি কম পরিষ্কার। বিভিন্ন সামুদ্রিক উদ্ভিদ, শৈবাল, প্রবাল, ঝিনুক, শামুক, বিভিন্ন প্রজাতির গর্তবাসী, পোকামাকড়, খোলসবিশিষ্ট প্রাণী, উদ্ভিদ ও বিভিন্ন সিলেনটারেটা (coelenterates) মহীসোপানের অগভীর পানিতে নিবাস গড়ে তোলে। এছাড়া বিভিন্ন সামুদ্রিক ক্ষুদ্র প্রাণী, স্টার ফিস, বৃটল স্টার, সি কুকুমবার ও স্পঞ্জ ফিস এই অঞ্চলে বসবাস করে। বাংলাদেশের উপকূলভাগের মহীসোপানের বিস্তার স্থানবিশেষে বিভিন্ন। হিরণ পয়েন্ট ও সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলভাগে এর বিস্তার ১০০ কিলোমিটারের কম।

 আবার কক্সবাজার উপকূলে তা ২৫০ কিলোমিটারেরও বেশি। সমুদ্রতলের শিলা বৈশিষ্ট্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায় বাংলাদেশের মহীসোপানে অবক্ষেপিত সূক্ষ্ম পলিকণার পরিমাণ দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমেই বেশি। এগুলো সবচেয়ে বেশি অবক্ষেপিত হয়েছে অন্তঃসাগরীয় গিরিখাত সোয়াচ অফ নো গ্রাউন্ডে। বাংলাদেশের মহীসোপানের বেশিরভাগ অংশ পলি ও কর্দমে আবৃত। চট্টগ্রাম ও টেকনাফের মহীসোপানের অগভীর অংশ (২০ মিটারের কম) বালি আবৃত এবং জোয়ারভাটার সময় সুগঠিত বালুকাবেলা দৃষ্টিগোচর হয়। এই অঞ্চলের মহীসোপানে দৃষ্ট বালু তরঙ্গের প্রকটতা খুবই উল্লেখযোগ্য (৩-৫ মিটার), যা উচ্চ শক্তিসম্পন্ন অবক্ষেপ পরিবেশের বিদ্যমানতা প্রমাণ করে। এমনকি সুন্দরবন-পটুয়াখালী-নোয়াখালী উপকূলে অবস্থিত মহীসোপানের দক্ষিণাংশের অগভীর অংশও পলি ও কর্দমে ঢাকা, যা তীর বরাবর কর্দমপূর্ণ জোয়ারভাটা গঠিত সোপান সৃষ্টি করেছে।

2.2.3.3     গভীর সমুদ্র

গভীর সমুদ্রে গভীরতার সাথে সাথে লবণাক্ততা বেড়ে যায়, এবং সেই সাথে সেখানের বাস্তুতন্ত্রও। বাংলাদেশের দক্ষিণে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড, যাকে স্থানীয়রা ‘নাই বাম’ বলে চিনে সেটি বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে গভীর স্থান। সেখানে দেখা মেলে ডলফিন, তিমি সহ আরো অনেক বিরল ও বৈচিত্র্যম সামুদ্রিক জীবের। এই সামুদ্রিক প্রাণীরা উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জীবিকাকে সমর্থন করার সাথে সাথে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যেও উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে।

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রজাতির ডলফিন এবং তিমি রয়েছে। ইরাবতী ডলফিন, বাংলাদেশের নদী ও মোহনায় বাস কর।  আর,  বোটলনোস  ডলফিন প্রায়ই গভীর সমুদ্রে দেখা যায়। উপরন্তু, বঙ্গোপসাগরে ব্রেডিস তিমি, যা কিনা একটি প্রজাতির বালিন তিমি (তাদের দাঁতের পরিবর্তে বালিন রয়েছে যা তারা সমুদ্র থেকে চিংড়ির মতো ক্রিল, প্লাঙ্কটন এবং ছোট মাছ সংগ্রহ করতে ব্যবহার করে), দেখা যায়।

সামুদ্রিক কচ্ছপ বাংলাদেশের সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। দেশের উপকূল মহাবিপন্ন অলিভ রিডলি কচ্ছপ সহ বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের জন্য ডিম পাড়ার জায়গা সরবরাহ করে। এই কচ্ছপগুলি সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং সাগর ঘাসের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং বাসস্থানের অবক্ষয়ের কারণে অনেক প্রজাতি আজ হুমকির সম্মুখীন। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে রয়েছে করাত মাছ (Sawfish), পিতাম্বরি (Guitarfish) এবং বিভিন্ন প্রজাতির হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ, যেমন সুন্দরবনের মহা বিপন্ন গ্যাঞ্জেস হাঙ্গর (Ganges shark) আর বিশাল আকৃতির মিঠাপানির শাপলাপাতা মাছ (Giant freshwater stingray)। এদের অনেক গুলো প্রজাতি উপকূলের অগভীর পানিতে ও সুন্দরবোনে বাচ্চা দিতে চলে আসে। এই প্রাণীগুলি সামুদ্রিক খাদ্য জালের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রজাতির জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক প্রাণীরা দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশগত স্বাস্থ্য এবং আর্থ-সামাজিক কল্যাণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাদের সুরক্ষা এবং সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং তাদের উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায়গুলির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারে।