ভূ-প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সুজলা সুফলা এ দেশে একসাথে টিকে থাকে বনভূমি, বন্যপ্রাণ আর মানুষ। আবার জীববৈচিত্র্যের সরল-সৌন্দর্যের একটি বড় নিয়ামক হলো তার বাসস্থান। বাংলাদেশের স্থলভূমি আর জলভূমি জুড়ে বেঁচে থাকা বন্যপ্রাণীগুলো অনেকটাই নির্ভর করে তার আবাসস্থল এর ধরন, বিস্তার, অবস্থা আর অবস্থান এর উপর। আইইউসিএন নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পাওয়া যায় ১৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭১১ প্রজাতির পাখি, ১৭৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৪ প্রজাতির উভচর এবং ৬৫৩ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ। আমরা এই নিবন্ধে প্রাণীকূল এবং বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও তার অবস্থা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো।

3.1    অমেরুদণ্ডী, মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি, ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাধারণ বিবরণ

3.1.1    অমেরুদণ্ডী প্রাণী

পৃথিবীতে আবিষ্কৃত প্রাণীর প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই অমেরুদণ্ডী প্রাণী। আমাদের চারপাশে মাকড়শা, শামুক, ফড়িং, প্রজাপতি থেকে শুরু করে অসংখ্য প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী আছে। বাস্তুতন্ত্রে এই প্রাণীগুলোর অসামান্য অবদান ও ভূমিকা রয়েছে। উদ্ভিদের পরাগায়নের বাহকের অধিকাংশই অমেরুদণ্ডী কীটপতঙ্গ। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও তোমাদের পরিচিত কিছু প্রাণী নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।

3.1.1.1     প্রজাপতি

প্রজাপতি Anthropoda পর্বের Lepidoptera বর্গের প্রাণী। প্রজাপতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর রঙিন ডানা। প্রজাপতি তার বিশাল শুঁড় দিয়ে মধু পান করে। আনুমানিক ২০ কোটি বছর আগে ওদের উদ্ভব হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ১৫-২০ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৩০টি প্রজাতি তালিকাভুক্ত হলেও মোট প্রজাতি সংখ্যা পাঁচ শতাধিক হতে পারে।

প্রজাপতি সচরাচর দিনে ফুলে ফুলে উড়ে রস পান করে। ফুলের পরাগায়ন ও গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। জীবনচক্র ডিম, শূককীট, মুককীট ও পূর্ণাঙ্গ পতঙ্গ—চার পর্বে বিভক্ত। প্রজাপতি দেখতে যতটা সুন্দর শূককীটগুলো কিন্তু মোটেও তেমন নয়। তা ছাড়া ওরা গাছের বেশ ক্ষতি করে। অবশ্য কোনো কোনো প্রজাতির শূককীট ফসলের ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে কৃষকদের উপকারও করে। শূককীট অনেক পাখির প্রিয় খাদ্য, তাই পাখিরাও প্রজাপতির ওপর কিছুটা নির্ভরশীল।

গুরুত্বপূর্ণ প্রজাপতির গোত্রগুলির মধ্যে রয়েছে Papilionidae (সোয়ালোটেইলস), এখানে আছে লেমন বাটারফ্লাই (Papilio demoleus এবং P. polytes)। Pieridae গোত্রের প্রজাপতি সারাদেশে বিস্তৃত। এদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর হলো বাঁধাকপির প্রজাপতি (Pieris brassicae)। বাড়িঘরের বাগান থেকে ঝোপঝাড় ও বনভূমির সর্বত্র বিভিন্ন পরিবেশে প্রজাপতি দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার চির-সবুজ ও আধা-চিরসবুজ বন এবং মধুপুরের পত্রমোচী বনে এদের প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। এদের জীবন ব্যবস্থা যেহেতু উদ্ভিদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত তাই পরিবেশের যেকোন প্রতিকূল পরিবর্তনে এরা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। খাদ্যচক্রে প্রজাপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা পাখি, টিকটিকি এবং উভচর প্রাণীদের শিকার। আদতে কোনো বাস্তুতন্ত্র কতটা ভালো আছে, তার নির্দেশক হচ্ছে প্রজাপতি। তুষারে-মোড়ানো অ্যান্টার্কটিকা বাদে বিশ্বব্যাপী প্রজাপতির বিচরণ রয়েছে। পৃথিবীতে প্রায় ১৯ হাজার প্রজাতির প্রজাপতি আছে। তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই অস্ট্রেলীয় অঞ্চলে বাস করে।

3.1.1.2     মৌমাছি

মৌমাছি  মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গ। এরা ফুলে ফুলে ঘুরে ফুলের নির্যাস (nectar) সংগ্রহ করে এবং তা থেকে অর্ধতরল মিষ্টি, মধু প্রস্ত্তত করে। কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি এই নির্যাস খাদ্যনালীর ক্রপ বা হানি স্টমাকে (crop or honey stomach) সংগ্রহ করে এবং এখানেই উৎসেচকের বিক্রিয়ায় তা ডেক্সট্রোজ ও লিভিউলোজে পরিণত হয়। পরিবর্তিত এই অংশটুকু কর্মী মৌমাছি মৌচাকের বিশেষ প্রকোষ্ঠে জমা করে। জমা করা এ তরল অংশই মধু। বাংলাদেশে মৌমাছির প্রধানত তিনটি প্রজাতি আছে, যথা: Apis indica, A. dorsata এবং A. florea। বেশ কিছুদিন আগে ইউরোপ থেকে Apis mellifera নামক একটি প্রজাতি বাংলাদেশে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য A. indica বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং কাঠের বাক্সে অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে এদেরকে প্রতিপালন করা যায়। A. dorsata বন্য প্রকৃতির, জঙ্গল কিংবা বাড়ির চারদিকের বড় বড় গাছে এদের চাক দেখতে পাওয়া যায়, এমনকি ঘরের কার্নিসেও এরা বাসা বাঁধে। পেশাদার মধু সংগ্রহকারী A. dorsata-র কলোনিকে মধুর উৎস হিসেবে বেছে নিয়ে মধু সংগ্রহ করে। সে কারণে কোন কোন সময় এসব মৌচাক এবং মৌমাছির ক্ষতি সাধিত হয়।

মৌমাছি প্রাণিজগতের অন্যতম পরিশ্রমী পতঙ্গ। ক্ষুদ্র এই জীবের বিপুল পরিশ্রমের পুরোটা ফল ভোগ করে মানুষ ও পরিবেশ। এই উপকারী প্রাণীদের জন্য একটি দিনও নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ। ৪ বছর ধরে ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে পালন হচ্ছে। মৌমাছি থেকে মধু, মোম পরাগ, রয়েল জেলি ও বিষ পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্য কোনো পতঙ্গ থেকে এত দামি ও প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি মৌমাছি বসত গড়ে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সঙ্গে মৌমাছির নিবিড় সম্পর্কই এ বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটিকে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হয়। এই মৌমাছিরাই বিশাল বনজুড়ে বিপুল পরাগায়নে সহায়তা করে বনের গাছ ও ফল উৎপাদনে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে।

মৌমাছিরা তৎপর না থাকলে, ফুলে ফুলে না বসলে বনে পরাগায়ন কমে যাবে। তাদের গাছের বংশবৃদ্ধির হার কমতে থাকবে। গাছ কমলে বিপজ্জনকভাবে ছোট হয়ে আসবে বনের পরিধি। এ জন্য বলা হয়, নতুন গাছের মাধ্যমে বনের বৃদ্ধি সচল রাখতে মৌমাছিরা বড় ভূমিকা রাখে।

3.1.1.3     শক্ত খোলসের প্রাণী

Anthropoda পর্বের Crustacea উপপর্বের প্রাণীদের ক্রাস্টেসিয়ান বলা হয়। এরা জলজ ও খোলস আবৃত প্রাণী। চিংড়ি, কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি এই দলভুক্ত প্রাণী। এই উপপর্বের প্রাণীরা বাস্তুতন্ত্রের খাদ্য-জালিকার অন্যতম যোগসূত্র হিসাবে কাজ করে। এসব প্রাণী প্রধানত স্বাদুপানি ও লোনাপানির বাসিন্দা। কয়েকটি থাকে আর্দ্রভূমিতে, কিছু আবার পরজীবী। এদের সবার থাকে একজোড়া করে শুঙ্গক (antennule) ও শুঙ্গ (antenna)। এদের খোলস  কাইটিন (chitin) নামক পদার্থে গঠিত এবং তারা খোলস বদলে বাড়তে থাকে।

অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির কাঁকড়া ও চিংড়ি বাংলাদেশে রয়েছে।  এদেশে স্বাদুপানির অন্তত ১০টি ও সামুদ্রিক ১৯টি প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। স্বাদুপানির গলদা চিংড়ি (Macrobrachium rosenbergii) বাণিজ্যিকভাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং কাঁকড়া ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। সামুদ্রিক চিংড়ির মধ্যে অর্থকরী প্রজাতি হলো কোলা চিংড়ি (Penaeus merguiensis), বাগদা চিংড়ি (P. monodon), চাপড়া চিংড়ি (P. indicus), বাঘাতারা চিংড়ি (P. semisulcatus), হরিনা চিংড়ি (Metapenaeus monoceros) এবং কুচো চিংড়ি (M. brevicornis)।

3.1.1.4     অন্যান্য

কীটপতঙ্গদের Lepidoptera বর্গের দুটি বড় দলের একটি হচ্ছে মথ। নানা ধরনের শুঙ্গ (সাধারণত আগা গদাকৃতি নয়), নিশাচর বা গোধূলিচর স্বভাবের জন্য এগুলি প্রজাপতি থেকে পৃথক। অধিকাংশ মথের আছে সামনের ডানার সঙ্গে পেছনের ডানা সংযোগকারী একটি কাঁটা, ফ্রেনুলাম (frenulum)। দিবাচর, উজ্জ্বল রঙের সরু ও পাতলা প্রজাপতির তুলনায় মথরা অনুজ্জ্বল ও অনাকর্ষী, শরীর ভারী, ওড়ে গোধূলি বা রাতের বেলায়। অবশ্য  লম্বাটে গড়নের উজ্জ্বল রঙের মথও আছে। মথদের আকারে পার্থক্য রয়েছে। বৃহত্তম মথদের একটি, লুনা মথের (Attacus atlas) ছড়ানো ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ সেমি, আর পাতা-খনক (leaf miner) ক্ষুদ্রতমদের ৩ মিমি। অন্যান্য পতঙ্গের মতো মথের শরীরও মাথা, বক্ষ ও উদরে বিভক্ত। মাথায় আছে শুঙ্গ, চোখ এবং সাইফনিং ধরনের মুখোপাঙ্গ। দুচোখের মাঝখান থেকে উঁচানো এক জোড়া শুঙ্গ, প্রায়শ ফিলিফর্ম। শুঙ্গ বাতাসের রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদী। পুরুষ মথ স্ত্রী মথের শরীর থেকে নিঃসৃত ফেরোমোনের ‘গন্ধ’ অনেক দূর থেকেও টের পায়।

পূর্ণাঙ্গ মথ নিশাচর জীবনযাপন করে। তবে কিছু কিছু মথ দিনেও ঘুরে বেড়ায়। প্রজাপতির মতো এরাও বাহারি রঙে ভরিয়ে তোলে বাংলার বন বনানী। ফুলের পরাগায়ণে কয়েক প্রজাতির মথের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাতে যেসব ফুল ফোটে তারা পরাগায়ণের জন্য নিশাচর মথের ওপরই সাধারণত নির্ভরশীল। আবার কিছু মথের দেহ নিঃসরিত বর্জ্য ব্যবহৃত হয় উন্নতমানের সিল্ক সামগ্রী তৈরিতে।

3.1.2    মৎস

নদীমাতৃক এই দেশে নদ-নদী, খাল-বিল এবং হাওর-বাওর জুড়ে দেখা মেলে হরেক রকমের মিঠাপানির মাছের, রুই, কাতলা, চাপিলা, কই, পুঁটি, ট্যাংরা, মলা, ঢেলা সহ শতশত রকমের মাছ। আবার বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ ও তার চকচকে রূপ আর ব্যাপক পরিচিতি নিয়ে এখানে জনসমাদৃত। এছাড়াও বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের বঙ্গোপসাগর, উপকূলীয় অঞ্চল এবং মোহনাতে পাওয়া যায় সামুদ্রিক সব মাছ যেমন- আইড়, রূপচাঁদা, অলুয়া, ভোল, কোরাল, টুনা ইত্যাদি, এখানে মাঝে মাঝে দেখা মেলে হরেক প্রজাতির  সমুদ্রঘোড়া মাছ (Hippocampus kuda), হাঙর (Selachimorpha), শাপলাপাতা (Himantura imbricata) এবং করাতমাছেরও (Epalzeorhynchos frenatum)। বাংলাদেশের এই জলের দুনিয়ায় মাছ ছাড়াও পাওয়া যায় তারামাছ, সমুদ্রশশা, অক্টোপাস, স্কুইডসহ মজার মজার সব প্রাণী।

এবার দুটো জলজ প্রাণী শাপলাপাতা ও হাঙ্গরের কথা বলা যাক।  ভূপৃষ্টের পরিবেশকে শকুন যেমন মরা-পচা জিনিসে খেয়ে সুস্থ রাখে, তেমনি হাঙর ও শাপলাপাতা সাগরের পানির সুস্থ পরিবেশ ধরে রাখতে ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে সমুদ্রে মরে যাওয়া মাছ ও প্রাণী খেয়ে বেঁচে খাতে এ দুটি প্রাণী। সাগরের ঝাড়ুদারের ভূমিকায় থাকা হাঙর ও শাপলাপাতা ইকোসিস্টেম রক্ষায় বড় ধরনের অবদান রাখছে। এছাড়া এ দুটি প্রাণী বৈশ্বিকভাবে অনেকটাই মহাসংকটাপন্ন। বিলুপ্তির উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছের প্রজাতি আমাদের জাতীয় আইন দ্বারা কঠোরভাবে সুরক্ষিত।

শাপলাপাতা মাছ স্টিং রে (Sting Ray) নামেও পরিচিত। শাপলাপাতার প্রজাতিসমূহের মধ্যে খর্বনাক শাপলাপাতা (Pastinachus solocirostris), রামি/চুনি শাপলাপাতা (Pateobatis uarnacoides), হরিণা শাপলাপাতা (Pateobatis uarnacoides), বাঘা শাপলাপাতা (Himantura leoparda), গোলাকার শাপলাপাতা (Maculabatis pastinacoides) এবং পাইন্যা শাপলাপাতা (Urogymnus polylepis) উল্লেখযোগ্য।

উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায়শই শাপলাপাতা মাছ কেনা-বেচার সংবাদ পাওয়া যায়। আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন যে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২  অনুসারে শাপলাপাতা মাছ ধরা, ক্রয়–বিক্রয় করা নিষেধ। এ ধরনের মাছ না ধরার জন্য জেলেদের সচেতন করার ক্ষেত্রে তরুণেরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।

হালদা বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ) নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। পৃথিবীর আর কোনো জোয়ার-ভাটার নদী থেকে রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা যায় না। বাংলাদেশে মৎস্য প্রজননক্ষেত্র অনেকগুলো আছে, কিন্তু মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয় এমন নদী একটিও নেই। হালদা নদীর আরেকটি বৈশিষ্ট রয়েছে।  আইইউসিএনের রেড লিস্ট অনুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ফ্রেশ ওয়াটার ডলফিন বা গাঙ্গেয় ডলফিন বেঁচে আছে। হালদা নদীতে এখনো ১৪৭টি গাঙ্গেয় ডলফিন বেঁচে আছে। আগে অন্যান্য নদীতেও এই ডলফিন পাওয়া যেত। অনেক নদী থেকে এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। একমাত্র হালদা নদীতেই এই ডলফিনের সবচেয়ে বড় পপুলেশন পাওয়া যায়।

তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে হালদা নদীতেই কেন রুই জাতীয় মাছেরা ডিম ছাড়ে। হালদা নদী এবং নদীর পানির কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য এখানে মাছ ডিম ছাড়তে আসে যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে ভিন্নতর। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক , রাসায়নিক ও জৈবিক। ভৌতিক কারন গুলোর মধ্যে রয়েছে নদীর বাঁক, অনেকগুলো নিপাতিত পাহাড়ী ঝর্ণা বা ছড়া প্রতিটি পতিত ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর গভীরতা, কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং অতি ঘোলাত্ব । রাসায়নিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কম কন্ডাক্টিভিটি, সহনশীল দ্রবীভুত অক্সিজেন ইত্যাদি । জৈবিক কারণগুলো হচ্ছে বর্ষার সময় প্রথম বর্ষণের পর বিল থাকার কারণে এবং দুকুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উপাদানের মিশ্রণের ফলে পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে যা প্রজনন পূর্ব গোনাডের পরিপক্কতায় সাহায্য করে। অনেকগুলো পাহাড়ী ঝর্ণা বিধৌত পানিতে প্রচুর ম্যাক্রো ও মাইক্রো পুষ্টি উপাদান থাকার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়, এই সব বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হালদা নদীতে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে যা বাংলাদেশের অন্যান্য নদী থেকে আলাদা। হালদা নদীর বাঁকগুলোকে “অক্সবো” বাঁক বলে। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পানির প্রচণ্ড ঘূর্ণন যার ফলে গভীর স্থানের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ভাবে গভীর স্থানগুলোকে “কুম” বা “কুয়া” বলা হয়। উজান হতে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য পদার্থ কুমের মধ্যে এসে জমা হয়। ফলে পানি অতি ঘোলা হয়। মা মাছেরা কুমের মধ্যে আশ্রয় নেয় এবং ডিম ছাড়ে।

ইলিশ (Hilsa) – আমাদের জাতীয় মাছ। এটি Clupeiformes গোত্রের Tenualosa গণের সদস্য। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়, Tenualosa. ilisha, T. toli এবং T. kelee। এর মধ্যে T. ilisha অধিক পরিমাণে সংগৃহীত হয়। ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ব্যাপক এবং এদের সাধারণত দেখা যায়  সমুদ্র,  মোহনা ও নদীতে। সমুদ্রে এরা পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর,  বঙ্গোপসাগর, ভিয়েতনাম ও চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। শাতিল আরব, ইরান ও ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস, পাকিস্তানের সিন্ধু, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীসমূহ, মায়ানমারের ইরাবতী এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় বিভিন্ন নদীসহ পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলি নদী ইলিশের আবাসস্থল।

ইলিশ প্রজননের উদ্দেশ্যে স্বাদুপানির স্রোতের উজানে অগভীর পানিতে উঠে আসে এবং ডিম ছাড়ে। মুক্ত ভাসমান ডিম থেকে পোনা বেরোয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ (জাটকা) নদীর ভাটিতে নেমে সমুদ্রে পৌঁছে বড় হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রজননক্ষম হয়ে জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য আবার নদীতে ফিরে আসে। ইলিশ মূলত প্ল্যাঙ্কটোনভোজী। নীল-সবুজ শৈবাল, ডায়াটম, ডেসমিড, কোপিপোড, রটিফার ইত্যাদিও খেয়ে থাকে। তবে এদের খাদ্যাভ্যাস বয়স ও ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ইলিশ বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও এককভাবে সর্বাধিক সংগৃহীত মাছ।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয় ও আমিষ সরবরাহে ইলিশের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সর্বোচ্চ। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার প্রধান উৎস হচ্ছে ইলিশ। প্রায় ৫.০ লক্ষ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশ্বে ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে। সারা বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের প্রায় 80 শতাংশ আহরিত হয় এ দেশের নদ-নদী থেকে।

3.1.3    উভচর প্রাণী

উভচর প্রাণীর মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ যেমন কুনোব্যাঙ, সোনাব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, কোলাব্যাঙ পাওয়া যায় বাংলাদেশের চিরসবুজ বন, শালবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। কিছু চিকিলা বা সিসিলিয়ান এরও দেখা পাওয়া যায় এখানে।

ব্যাঙ (Frog and Toad) Amphibia  শ্রেণির Anura বর্গের উভচর প্রাণী। গোটা বিশ্বে ব্যাঙের ২৮টি গোত্র এবং ৩৩৮টি গণের অধীনে প্রায় ৪,৩৬০টি প্রজাতি আছে। বাংলাদেশে উভচর শ্রেণির একটিমাত্র বর্গ (Anura) রয়েছে, কিন্তু Gymnophiona (caecilians) ও Caudata (salamanders ও newts) বর্গের কোন প্রজাতি নেই। ব্যাঙ ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা জীবনধারণের জন্য কখনও ডাঙায় আবার কখনও জলে বিচরণ করে। বাংলাদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, বনজঙ্গলসহ প্রায় সব জায়গাতেই বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ দেখা যায়। এদের মধ্যে কোলাব্যাঙ অন্যতম। এরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আকারের ব্যাঙ। সোনাব্যাঙ নামেও অনেকের কাছে এরা পরিচিত। এদের ইংরেজি নাম Indian Bull Frog. বৈজ্ঞানিক নাম Hoplobatrachus tigerinus. এরা দেখতে ধূসর, বাদামি ও হলদে রঙের। স্ত্রী ও পুরুষ ব্যাঙের রঙে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শক্তিশালী পায়ের কারণে এরা জলে-স্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। আগে বর্ষা মৌসুমে গ্রাম-বাংলার জলাশয়গুলো এদের ডাকাডাকিতে মুখরিত থাকত। এখন আগের মতো দেখা যায় না।

3.1.4    সরীসৃপ

সরীসৃপ Reptilia শ্রেণীর মেরুদন্ডী প্রাণীর। প্রাণিজগতে এদের অবস্থান উভচর ও পাখিদের মধ্যবর্তী। কাছিম ও কাউঠা, টিকটিকি, সাপ, কুমির এবং টুয়াটারা (Sphenodon) সরীসৃপ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরা প্রধানত চতুষ্পদী, কিন্তু সাপ ও কিছু টিকটিকি উপাঙ্গহীন। এদের ত্বকের বহির্ভাগ বহিস্ত্বকীয় আঁশে ঢাকা, যা ত্বককে আঘাত ও শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে। বাংলাদেশে অজগর সাপ ও তক্ষক বেশ পরিচিত সরীসৃপের মধ্যে। বাংলাদেশে অজগরের দুটি প্রজাতি আছে। এর একটি অজগর বা ময়াল সাপ (Python molurus), এবং অন্যটি গোলবাহার (Python reticulata), এদের মধ্যে আকারে বড় ময়াল সাপ। এরা ৫.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অথবা দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মিশ্র-চিরহরিৎ বন ও সুন্দরবনে এদের পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দুটি প্রজাতিই বিরল। দেশে উভয়কে বিপন্ন অথবা অতি বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অজগর স্তন্যপায়ী, পাখি এবং সরীসৃপজাতীয় প্রাণী খায়। তবে স্তন্যপায়ী প্রাণী বেশি পছন্দ করে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইঁদুর, খরগোশ, ছাগল, ভেড়া, শিয়াল এবং হরিণ শিকার করে। খাবার পূর্বে অজগর তার শিকার পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলে। অন্যান্য সরীসৃপের মধ্যে রয়েছে কচ্ছপ, কাছিম, কুমির ও ঘড়িয়াল, গুইসাপ ও তক্ষক।

3.1.4.1     কচ্ছপ ও কাছিম

পৃথিবীতে টিকে থাকা আদিম প্রাণিগুলোর মধ্যে কচ্ছপ-কাছিম অন্যতম। শতশত বছর ধরে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে তারা আজও বেঁচে আছে। আমাদের দেশের বন-জঙ্গলে এক সময় প্রচুর কচ্ছপ ও হাওড় অঞ্চলে কাছিমের দেখা মিলত। তবে নানা কারণে কমছে কচ্ছপ-কাছিমের সংখ্যা। ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স’র তথ্যমতে, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৩৬১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিম টিকে রয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বর্তমানে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে ২৫ প্রজাতির মিঠাপানির কচ্ছপ-কাছিমের দেখা মেলে। এর মধ্যে ২১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিমকে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন, মহাবিপন্ন ও সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে আইইউসিএন। তোমরা কি বলতে পারবে  কচ্ছপ এবং কাছিমকে আলাদা কেন ? এদেরকে চেনার করার সহজ উপায় হলো, যেগুলো পানিতে থাকে সেগুলো কাছিম এবং যেগুলো স্থলে বসবাস করে সেগুলো কচ্ছপ।

কাছিম মূলত কিলোনিয়া বা চিলোনিয়া (Chelonia) বর্গের অন্তর্ভুক্ত। কাইট্টা, কাছিম বা, কচ্ছপ নাম প্রায় একই মনে হলেও সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রচলিত নাম রয়েছে। যেমন, পিঠে নরম বর্ম থাকলে তাকে কাছিম, শক্ত বর্মের ডাঙায় থাকা প্রাণিদের কচ্ছপ, শক্ত বর্মের পানিতে থাকা প্রাণিদের কাইট্টা এবং সমুদ্রে বসবাসকারীদের সামুদ্রিক কাছিম নামে লোকমুখে অভিহিত করা হয়। তবে সাধারণত কিলোনিয়া বর্গের সবাইকেই এক কথায় কাছিম বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন ৫ গোত্রের প্রায় ২৫ প্রজাতির কাছিম দেখা যায়।

সরীসৃপ শ্রেণির হলেও কাছিম দেখতে অনেকটা গোলাকার এর বিশেষ আকৃতির কারণে। কাছিম বলতেই চোখে ফুটে উঠবে পিঠে নরম বা, শক্ত খোলার আবরণধারী প্রাণি যে প্রয়োজনে তার শরীর খোলার ভিতরেই পুরোটা ঢুকিয়ে নিতে পারে। পিঠের দিকে উঁচু উত্তল কৃত্তিকাবর্ম বা, (Carapace) এবং নিচে বুকের দিকে চ্যাপ্টা বক্ষস্ত্রাণ (Plastron) এর বিশেষ শারীরিক গঠন দান করে। ঘাড়, মাথা, অগ্রপদ, পশ্চাৎপদ, অবসারণী ছিদ্র, লেজ বাদে বাকি অংশ খোলার অভ্যন্তরেই থাকে। কৃত্তিকাবর্ম ও বক্ষস্ত্রাণ দেহের দুই পাশের বাকি অংশে জোড়া লাগানো থাকে। এদের দাঁত না থাকলেও চোয়লের শক্ত আঁকাবাঁকা গঠন দিয়েই এরা শক্তভাবে কোনোকিছু ধরা, কাটা এবং ছিঁড়ে ফেলতে পারে। এদের কৃত্তিকাবর্মের ভিতরে বুকের পাঁজর ও কশেরুকা এমনভাবে যুক্ত হয়ে থাকে যে এরা চাইলেও পাঁজরের হাড় দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ ইচ্ছানুযায়ী চালনা করতে পারে না। ফলে, ভয়ার্ত কাছিম যদি সমস্ত দেহ খোলের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়, জায়গা স্বল্পতায় শ্বাসপ্রশ্বাসের বিঘ্ন অল্প সময় পরেই শুরু হয়ে যায়।  নখরযুক্ত এই প্রাণিটি অক্সিজেন রক্তের পাশাপাশি মাংসপেশির মায়োগ্লোবিন (Muscular myoglobin) এর মাধ্যমেও ধরে রাখতে পারে। যেসব কাছিম সমুদ্রে থাকে, তাদের অবসারণী ছিদ্রের পাশে থাকা রক্তনালীযুক্ত পর্দার সাহায্যেও ফুসফুসের পাশাপাশি অক্সিজেন নিতে পারে। অতি পরিমাণে মাংসধারী এ প্রাণিটিকে কোনো কোনো এলকায় জলখাসীও বলা হয়ে থাকে। মেয়ে কাছিম একটু ভারী ও এদের লেজ মোটা। অন্যদিকে পুরুষ কাছিম সাধারণত মেয়ে কাছিমের তুলনায় চ্যাপ্টা ও লম্বা লেজের গঠনসমৃদ্ধ হয়।

বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম পাওয়া যায়। তার মধ্যে চারটি কিলোনিডী ও একটি ডারমোকেলিডী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। প্রজাতি পাঁচটি হল যথাক্রমে ডারমোকেলিস কোরিয়াসিয়া (Dermochelys coriacea), ইরিটমোকোলিস ইমব্রিকাটা (Eretmochelys imbricata), কিলোনিয়া মাইডাস (Chelonia mydas) বা,  গ্রিন টারটল, কেরেটা কেরেটা (Caretta caretta) বা, লগারহেড টাইটল এবং লেপিডোকেলিস অলিভেসিয়া (Lepidochelys olivacea) বা, অলিভ রিড্লেটারটল। বাংলাদেশে সামুদ্রিক কাছিম মূলত পশ্চিমে হরিণটানা ও রাইমঙ্গল নদীর মোহনা হতে পূর্বের নাফ নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত এবং বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির মধ্যে পাওয়া যায়। শীত হতে বর্ষার শুরু পর্যন্ত এদের ডিম পাড়ার সময়, তখন এসব সৈকত অথবা প্রবালদ্বীপের বালুবেলায় এরা ডিম পাড়ে ও রোদ পোহাতে আসে।

বাসস্থানের অভাব, প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংস, কৃষি জমি তৈরি বা চাষের জন্য বনভূমি পোড়ানো এবং বিশেষ কিছু ধর্মের মানুষের কাছে কচ্ছপের মাংস প্রিয় হওয়ায় শিকারের উৎসবে হারিয়ে যাওয়ার শেষ প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের কচ্ছপ এবং কাছিম। বিলুপ্ত হওয়ার শেষ প্রান্তে থাকা এসব কচ্ছপ এবং কাছিমকে সংরক্ষণের জন্য আমাদের সকলে সচেষ্ট থাকা উচিৎ।

3.1.4.2     কুমির ও ঘড়িয়াল, গুইঁসাপ এবং তক্ষক

 Crocodilia বর্গের বৃহৎ মাংসাশী সরীসৃপ হলো কুমির ও ঘড়িয়াল। এই  বর্গের ৩ গোত্র Crocodylidae (কুমির ১৩ প্রজাতি), Alligatoridae (অ্যালিগ্যাটর ২ প্রজাতি) এবং Gavialidae (ঘড়িয়াল ২  প্রজাতি)। এগুলি উষ্ণমন্ডলীয় ও উপউষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে জলাভূমি বা নদীর তীরে বাস করে ও পানিতে শিকার ধরে। কুমিরের শরীর ও লেজ চ্যাপ্টা, পা খাটো ও চোয়াল শক্তিশালী। মাথার আগার কাছাকাছি চোখ, কান ও নাকের ছিদ্র এবং পানিতে ভেসে থাকার সময় এগুলি খোলা থাকে।

ছোট কুমির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খেয়ে থাকে। বড় কুমির মাছ ছাড়াও পানির কাছাকাছি আসা ডাঙ্গার স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি ও শিকার করে। কুমিরগোষ্ঠীর কতকগুলি বৃহদাকার সদস্য কখনও কখনও মানুষকে আক্রমণ করে। স্ত্রী কুমির নদীর তীরে পচা আগাছা দিয়ে তৈরি বাসায় বা অগভীর গর্তে সাধারণত ২০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফোটার শব্দ শুনলে সেগুলি মাটি খুঁড়ে বের করে। অধিকাংশ প্রজাতির কুমিরের গড় দৈর্ঘ্য ১.৮-৩ মিটার তবে সর্ববৃহৎ কুমির, সুন্দরবনের লোনাপানির কুমির  (Crocodylus porosus) ৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা, ওজন প্রায় ১৫০০ কিলোগ্রাম হয়ে থাকে। স্বাদুপানির জলাভূমির কুমির বা মকর (Crocodylus palustris) বাংলাদেশে মুক্ত জলাশয়ে এই কুমির আর নেই। অবশ্য কয়েকটিএখনও দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলায় হযরত খানজাহান আলীর দরগাহর পুকুরে দেখা যায়।

ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus) অত্যন্ত লম্বা, সরু ও যা  বৈশিষ্ট্যে কুমির থেকে স্পষ্টত পৃথক। ঘড়িয়ালের নামকরণের একটা মজার কাহিনী আছে। এদের চোয়াল মাথা থেকে ক্রমশ সরু হতে থাকে, তারপর হঠাৎ চোয়ালের শেষপ্রান্তে এসে বেশ মোটা ও ভোঁতা হয়ে যায়। পুরুষ ঘড়িয়ালের এই ভোঁতা প্রান্ত কলস বা ঘড়ার মতো ছোট একটি বর্ধিত অংশ দেখা যায়। এই ঘড়ার মতো অংশের জন্যই এদের ঘড়িয়াল নামকরণ করা হয়। আর ইংরেজরা এই ঘড়িয়ালকেই ভুলভাবে উচ্চারণ করে ডাকতেন গেভিয়াল, যা থেকে এর ইংরেজি নামের উৎপত্তি। বাংলাদেশের দক্ষিণে সুন্দরবনে মোহনার কুমির (Crocodylus porosus) এবং উত্তরে পদ্মা নদীতে ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus) রয়েছে।

মিঠা পানিতে বাস করা এই প্রাণী লোকজন বিরক্ত না করলে দিনের বেশিরভাগ সময়েই বালুচরে মুখ হাঁ করে শুয়ে থাকতে পছন্দ করে, কিন্তু দিনের বেলা সে সুযোগ খুব কম হয় বলে তাদের রাতের দিকেই চরে শুয়ে বিশ্রাম নিতে হয়। শুনে হাস্যকর মনে হলেও এটা সত্য যে, এদের মুখ হাঁ করে বিশ্রাম নিতেই বেশি সুবিধা হয়, কেননা এদের মুখ বন্ধ করার চেয়ে খোলা রাখাই কম কষ্টসাধ্য। কারণ মুখ খোলার সাথে সাথেই তা চোয়ালের মাংসপেশীর সাথে তালা চাবির মতো লেগে যায়, ফলে মুখ খোলা রাখাই সহজতর হয়।

ঘড়িয়ালের খাদ্যাভাস ও খাদ্যগ্রহণ  কৌশল বেশ কৌতুহলোদ্দীপক। আমরা এদেরকে কুমিরের সাথে গুলিয়ে ফেলে ভুল করি, আসলে এদের থেকে আমাদের জীবননাশের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এদের প্রধান খাদ্য মূলত আঁইশবিহীন মাছ যেমন, বোয়াল ,পাঙ্গাস ,আইড় ইত্যাদি। এজন্য এদের আমরা কখনো কখনো মেছো কুমিরও বলে থাকি। এরা সাধারণত পুরো মাছকে মুখে নিয়ে আস্ত গিলে ফেলে। বোয়াল, পাঙ্গাস ,আইড় মাছগুলো রাক্ষুসে ও মাংসাশী ,যারা অন্য তৃণভোজী মাছ যেমন, রুই ,কাতলার মতো মাছের ডিম ,পোনা খেয়ে তাদের সংখ্যা হ্রাস করে। কিন্তু ঘড়িয়াল বোয়াল, পাঙ্গাস খেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।

যখন বসন্তকালে এক ঘড়িয়াল অন্য এক ঘড়িয়ালের ঘাড় কামড়ে ধরার চেষ্টা করে কিংবা ধাওয়া করে বেড়ায় তখন বুঝতে হবে এটা তাদের প্রজননের পূর্বপ্রস্তুতি। পুরুষ ও স্ত্রী ঘড়িয়ালের এই রাগের পালা শেষ হয় দৈহিক মিলনের মাধ্যমে। মিলনের পর ডিম পাড়তে মা ঘড়িয়াল বালুচরে এসে সুবিধাজনক স্থানে গর্ত করে একসাথে ৪০-৫০টা ডিম পাড়ে, এটাকে ঘড়িয়ালের বাসা বলা হয়। ডিমগুলো রাজহাঁসের ডিম থেকেও বেশ বড় ও সাদা ধবধবে। ওজন প্রায় ২৫০ গ্রামের কাছাকাছি। দেখতে পুরু খোলসযুক্ত ক্যাপসুলের মত। এ পুরু খোলস এদেরকে ভেঙে যাওয়া থেকে রক্ষা করে, আবার আর্দ্রতাও ধরে রাখে।

ঘড়িয়ালের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ, তারপরে তারা নিজেরাই কিংবা অপরাপর কুমির। মানুষ ওদের চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ব্যাগ, বেল্ট, জুতা বানায়। অনেকে মাংস বা ডিমের জন্য হারপুন দিয়ে মেরে ফেলে। অনেকে আবার নিজের আনন্দ কিংবা বীরত্ব দেখাতে গুলি করে ঘড়িয়াল মারে। এখন নাইলনের ফাঁসি জালে আটকেও অনেক ঘড়িয়ালের শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হচ্ছে। বাচ্চা ঘড়িয়ালকে অনেক সময় বড় ঘড়িয়াল, কুমির, শিকারী পাখি বা বোয়াল মাছ খেয়ে ফেলে। তাছাড়াও চর জনপদে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধিও এদের সংখ্যাহ্রাসের অন্যতম একটা কারণ। পদ্মার পাড় থেকে হয়তো ঘড়িয়াল বিলুপ্ত হয়েছে ইতোমধ্যে, যমুনার তীরে দুই-একটা বেঁচে থাকতে পারে। তবে এখনো আমাদের সু্যোগ আছে ঘড়িয়ালকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার। এক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারতের মত ঘড়িয়াল পুকুর বানানো যেতে পারে কিংবা যেখানে ঘড়িয়াল পাওয়া যায় তা ঘড়িয়ালের জন্য অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। সর্বোপরি আমাদের সচেতনতা ও ঘড়িয়ালের প্রতি সদয় আচরণ ওদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে। নতুবা অচিরেই ঘড়িয়ালমুক্ত হবে বাংলাদেশ।

গুঁইসাপ

বাংলার একসময়ের অতিপরিচিত সরীসৃপ ছিলো গুঁইসাপ। চিনা লোককথার টিকটিকি সদৃশ এই প্রাণি এখন প্রায় দেখাই যায় না। গুঁইসাপের বৈজ্ঞানিক নাম Varanus bengalensis. এরা Squamata বর্গের Varanidae গোত্রের প্রাণি। যদিও বিবর্তনের ধারায় বহুলক্ষ বছর ধরেই গুঁইসাপ পৃথিবীর বুকে বিচরণ করছে, এদের এখন কেবল গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলেই দেখা যায়। বিভিন্ন কিংবদন্তীর অংশ এই সাপ এখন বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত।

গুঁইসাপকে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় বেশি দেখা যায়। গ্রামাঞ্চল, ছোট ঝোপঝাড়, জলাভূমির পাশের এলাকা এদের আদর্শ বাসস্থান। এদের সুন্দরবন ছাড়াও গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন বনভূমি, তাপক্লিষ্ট মরুভূমি এবং নদী উপত্যকায় পাওয়া যায়। এছাড়াও গাছের কোটর, খানাখন্দে এরা বিশ্রাম নেয়। গুঁইসাপ গাছে উঠতে যেমন পারদর্শী তেমনই সাঁতারেও পটু।

সরীসৃপ হওয়ায় গুঁইসাপও শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণি বা Poikilothermic অর্থাৎ, দেহের তাপমাত্রা পরিবেশের সাথে ওঠানামা করে। তবে জৈবিক কজের জন্য গুঁইসাপ দরকারি তাপ গ্রহণ করে সূর্য থেকে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এদের শরীরের তাপমাত্রা ৩৪-৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে পৌঁছালে এরা ঝোপঝাড়ে বা গর্তে আশ্রয় নেয়। বিকালে সূর্য পশ্চিমদিক বরাবর থাকলে এরা সোজা হয়ে শুয়ে থাকে যেন সমস্ত শরীর দিয়ে তাপ গ্রহণ করতে পারে। শীতকালে তাপগ্রহণের জন্য দেহকে সরাসরি সূর্যের আলোর নিচে রাখে।

গুঁইসাপের প্রিয় খাবার পাখি, পাখির ডিম, ইঁদুরসহ অগণ্য ছোট প্রাণি। গুঁইসাপ সাপের প্রবল শত্রু। গুঁইসাপের চামড়া শক্ত হওয়ায় সাপের দাঁত চামড়া ভেদ করতে পারে না। ফলে বিষধর সাপেরাও এদের এড়িয়ে চলে। গুঁইসাপ তার শিকারকে সরাসরি গিলে ফেলে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মুখগহ্বর ছোট-বড়ও করতে পারে।

গুঁইসাপ নিজের শত্রুকে দেখলে হিসহিস শব্দ করে। আত্মরক্ষা করতে হলে শরীর ফুলিয়ে লেজ দিয়ে বারবার শত্রুকে আঘাত করতে থাকে। সুযোগ পেলে এরা মানুষকেও কামড়াতে ছাড়ে না। এই কামড় ছাড়ানো তখন অনেক শক্ত হয়ে যায়। তবে সাধারণত এরা যুদ্ধে জড়ায় না। বিপদ বুঝলেই গাছে উঠে যায়। আবার শিকার ধরার আশায় মাটিতেও নিঃশব্দে মিশে থাকে। দেহের জলপাই রঙের জন্য এদের তখন আলাদাভাবে বোঝা যায় না। যদিও এরা হাঁস-মুরগি এবং এদের ডিম খেয়ে গৃহস্থের ক্ষতি করে, এরা শস্য বিনষ্টকারি ইঁদুর, কাঠবিড়ালী ইত্যাদি প্রাণি মেরে উপকারও করে।

একসময় গুঁইসাপের জন্য গ্রামাঞ্চলে মানুষ প্রচন্ড সাবধানে থাকতো। তবে গুঁইসাপ এখন প্রায় দেখাই যায় না। রঙচঙে চামড়ার জন্য মানুষ গুঁইসাপ মেরে নানারকম ব্যাগ, জুতা ইত্যাদি তৈরির জন্য বিক্রি করতে থাকে। এর চামড়ার দাম বিদেশেও অনেক। নির্বিচারে হত্যার জন্য গুঁইসাপ লোকালয়ে তো দেখাই যায় না, বর্তমানে প্রকৃতি থেকেও বিলুপ্তপ্রায়।

তক্ষক

Lacertilia বর্গের Gekkonidae গোত্রের একটি গিরগিটি প্রজাতি তক্ষক। পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটে ধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোঁটাগুলি পাশাপাশি ৭-৮টি সরু সারিতে বিন্যস্ত। এরা  কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি, ছোট  পাখি ও ছোট  সাপ খেয়ে থাকে। ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকর বা গর্তে অথবা গাছে বাস করে। তক্ষক রাতে খুব পরিষ্কার দেখতে পায়। তক্ষকের অক্ষিগোলকে ট্রান্সপারেন্ট মেমব্রেন থাকে যা তাকে মানুষের চেয়ে ৩৫০ গুণ বেশি দৃষ্টিসম্পন্ন করেছে। তক্ষক আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মিতেও (বেগুনি ও সবুজ) খুব পরিষ্কার দেখতে পায়। অন্যান্য আত্মরক্ষী প্রাণীদের মতো তক্ষকের ইন্দ্রিয়ক্ষমতা দাপুটে। এটির শরীরের লেজ, দাঁত, পা প্রভৃতি কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তা আবার প্রাকৃতিকভাবে গজাতে পারে‌।

তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেক দূর থেকে শোনা যায়; ডাকের জন্যই এই নাম। কক্‌কক্‌ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্‌-ক্কা’ ডাকে কয়েক বার ও স্পষ্টস্বরে। ভুলবশত এটিকে বিষাক্ত মনে করা হলেও এই সরীসৃপ মোটেই বিষাক্ত নয় তবে স্বভাবসুলভ কিছুটা আগ্রাসী ভাব আছে এদের,কামড় দিলে জ্বালাপোড়া করে এবং ক্ষতস্থানে ব্যাথা হতে পারে।

অনেক সময় প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হিসেবে দেখা যায় কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে তক্ষক, যা মূলত রক্তচোষা, আনজিলা,শান্ডা নামেও পরিচিত এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এই বুনো টিকটিকি জাতীয় প্রাণী নিয়ে গুজবের শেষ নেই যা এর অস্তিত্বকে আজ সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্ডার তেল নামে এই প্রাণিটির তেল বিক্রি করা হয়। চোরাকারবারি এবং অসাধু মানুষ ক্যান্সার নিরাময়কারী ওষুধ নামে বিক্রি করে এই প্রাণী। আবার ভবিষ্যৎ গণনাকারী কিছু মানুষ ডাইনোসরদের বংশধর হিসেবে চিন্তা করে ভবিষ্যৎ গণনাকারী হিসেবে এটা ব্যবহার করে,যা প্রতারণা আর ভণ্ডামির সামিল। মূলত এসব কারণেই এই প্রাণীটি আজ সংকটাপন্ন। তক্ষক কেনাবাচা বা সংরক্ষণ আন্তর্জাতিকভাবেই অবৈধ,বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কাজেই এ ধরণের সকল গুজব্ব ও অবৈধ লেনদেন, তক্ষক শিকার থেকে নিজেদের বিরত থাকতে আমাদের সচতনতা জরুরী।

3.1.4.3     বিষধর ও নির্বিষ সাপ

Serpentes বর্গভুক্ত লম্বা ও সরু গড়নের সরীসৃপ হলো সাপ। সাপ বছরে কয়েকবার ত্বক বদলায়। অধিকাংশ মেরুদন্ডী প্রাণীর কশেরুকার তুলনায় সাপে কশেরুকার সংখ্যা বেশি (মানুষে ৩২, সাপে ৪ শতাধিক)। এদের ফুসফুস একটি। (ব্যতিক্রম অজগর, যাদের দুটি ফুসফুস)। সাপের কান নেই তাই বায়ুবাহিত শব্দ শোনে না, কিন্তু ভূমি থেকে করোটির হাড়ে পরিবাহিত নিম্ন-কম্পনাঙ্কের তরঙ্গ (১০০-৭০০ Hz) অনুভব করতে পারে।

সাপের মুখের তালুতে একটি সংবেদী (chemosensory) অঙ্গ থাকে এবং চলাচলের সময় সাপের জিভের মাধ্যমে সংবেদন গ্রহণ করে। সাপের স্বরযন্ত্র না থাকলেও  হিস্ হিস্ শব্দ করতে পারে। অধিকাংশ সাপই স্থলচর এবং কোন কোনটি গর্তবাসী অথবা বৃক্ষবাসী। জলচর সাপও আছে এবং পুরো একটি দলের সাপের সবগুলিই সামুদ্রিক। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের সাপেরা শীতনিদ্রায় যায়। সাধারণত একা থাকাই অভ্যাস, তবে খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রয়োজনে কখনও একত্রে জড়ো হয় এবং শীতনিদ্রায় অনেকগুলি একত্রে থাকে। ছোট সাপ পতঙ্গভুক এবং বড় সাপ নিজ দেহের তুলনায় বড় আকারের প্রাণী খায়।

সাপে কাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে এবং বন্যার সময় বিভিন্ন প্রকারের সাপের উপদ্রব দেখা দেয়। প্রতি বছর আমাদের দেশে সাপের কামড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। শহরের চেয়ে গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ সচেতনতার অভাব, সঠিক চিকিৎসার অভাব বা চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হওয়া। এখনো অনেক গ্রামে কুসংস্কার আছে, সাপে কাটলে ওঝা বা বেদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনেকেই সাপে কাটলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীভাবে চিকিৎসা নিতে হবে বা সাপে কাটলে করণীয় কী তা জানেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, শুধু সঠিক জ্ঞানের অভাবে মারা যান।

সাপে কাটোলে যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখন প্রতিটি সরকারি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে সাপের এন্টিভেনম পাওয়া যায়। কাজেই, আতংকিত না হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার আশ্বস্ত করতে হবে এবং সাহস দিতে হবে। নির্বিষ সাপের কামড়েও আতঙ্কিত হয়ে মানসিক আঘাতে মারা যেতে পারে মানুষ। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাপই বিষহীন, অল্প কিছু সাপ বিষধর। আবার বিষধর সাপ পর্যাপ্ত বিষ ঢুকিয়ে দিতে ব্যর্থ হতে পারে। এসব জানানোর মাধ্যমে রোগীকে আশ্বস্ত করা যেতে পারে।

জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে গোখরা, কেউটে ও চন্দ্রবোড়া এই তিন ধরনের বিষধর সাপ গুরুত্বপূর্ণ। সাপ কেবল আত্মরক্ষার জন্য কিংবা উত্যক্ত করলে মানুষকে দংশন করে, তাই সাপকে এড়িয়ে চলাই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। ঘাস বা ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে চলাফেরার সময় সাবধানে চলতে হবে। মাছ ধরার চাঁই কিংবা জালের মধ্যে সাপ আছে কিনা তা দেখে নিতে হবে। রাতে হাটার সময় আলো ও লাঠি সাথে রাখতে হবে। গরমের দিনে বাইরে ঘুমানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

3.1.5    পাখি

প্রজাপতি ও ফড়িং বাদে পৃথিবীর বুকে আরও যে উড়ন্ত সৌন্দর্য রয়েছে সে হলো পাখি। সাধারণভাবে পাখি হলো পৃথিবীজুড়ে নানা ধরনের পরিবেশে বসবাসকারী বিভিন্ন আকার-আকৃতি, ওজন ও বর্ণের উষ্ণ-রক্তবিশিষ্ট মেরুদণ্ডী প্রাণী যাদের দেহ পালকে আচ্ছাদিত, চোয়ালের উপর রয়েছে দাঁতবিহীন শক্ত চঞ্চু বা ঠোঁট, হৃৎপিন্ড চার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত, স্ত্রীরা শক্ত খোলসযুক্ত ডিম পাড়ে, দেহের বিপাকীয় হার বেশি, হাড় ফাঁপা ও কঙ্কাল হালকা এবং, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, যারা সচরাচর উড়তে সক্ষম।  বিশ্বব্যাপী কমবেশি ৯,৯৩০ প্রজাতি (Species) ও ২২,০০০ উপপ্রজাতির (Subspecies) পাখি রয়েছে। অনুমান করা হয়, বিভিন্ন প্রজাতির এই পাখিগুলোর মোট সংখ্যা ২০-৪০ হাজার কোটি। পুরো ভারতে যেখানে ১,৩১১ প্রজাতির পাখির বাস, সেখানে বাংলাদেশে কমবেশি ৭২২ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গত কয়েক শতকে দু শ’ প্রজাতির পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে প্রায় বার শ’ প্রজাতির পাখি নানা কারণে হুমকির সম্মুখীন।  

বাংলাদেশের পাখপাখালি বেশ বৈচিত্র্যময়। চড়ুই, দোয়েল, শালিক, ময়না, সারস, বক, ইষ্টিকুটুম, বসন্তবৌরী, মাছরাঙা সহ দারুন সব রং-বেরঙের পাখির দেখা মেলে বাংলাদেশের সর্বঅঞ্চলে। দেশীয় এ পাখিগুলো ছাড়াও প্রতিবছর শীতে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি আসে বাংলাদেশে, যেমন- সরালী, কালোমাথা গাঙচিল, পানচিল ইত্যাদি। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা এই পাখিগুলোর সাময়িক আবাসস্থল হয় বাংলাদেশের বিশিষ্ট এবং চিহ্নিত কিছু স্থান।

3.1.5.1     আবাসিক পাখি

বাংলাদেশের মোট পাখির মধ্যে কমবেশি ৩৪০ প্রজাতি স্থায়ীভাবে বসবাস করে, অর্থাৎ এরা সারাবছর এদেশে থাকে, ডিম পাড়ে ও ছানা তোলে। এরাই হলো এদেশের আবাসিক পাখি (Resident Bird)। এছাড়াও প্রায় ৩৭২ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী (Migratory – অর্থাৎ বছরের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় এদেশে আসে, বসবাস করে ও সময়মতো মূল আবাসে ফিরে যায়), পন্থ-পরিযায়ী ও ভবঘুরে। এসব পাখি এদেশের মানুষের কাছে আগে, এমনকি এখনও, ‘অতিথি পাখি’ নামেই পরিচিত। এদেরই এক বিশাল অংশ এদেশে আসে শীতকালে যারা শীতের পরিযায়ী পাখি (Winter Migrant) নামেও পরিচিত। এরা এদেশে বংশবিস্তার করে না। এছাড়াও কিছু পাখি গ্রীষ্মেও পরিযায়ন করে, যেমন- বিভিন্ন প্রজাতির কোকিল (Cuckoo) ও সুমচা (Pitta) পাখি। এরা গ্রীষ্মের প্রজনন পরিযায়ী (Summer Breeder Migrant) বলে থাকেন। এছাড়াও বেশকিছু প্রজাতির পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি এদেশে অনিয়মিত। হয়তো এক বছর এল, এরপর আবার ৫ বা ১০ বছর পর এল, অন্যদের মতো প্রতি বছর এল না। এদেরকে তাই যাযাবর বা ভবঘুরে বা অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি বলে। আর এদের সংখ্যাও নেহাত কম না, এদেশে আসা সকল পরিযায়ী পাখির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এরা। আবার কোনো কোনো প্রজাতির পাখি অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের এক পর্যায়ে এদেশে স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে আসে, যেমন- বাদামি চটক (Asian Brown Flycatcher), বন খঞ্জন (Forest Wagtail) ইত্যাদি। এরা পন্থ-পরিযায়ী (Passage-migrant) পাখি নামে পরিচিত। মূলত হেমন্তে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে অন্য কোনো দেশে পরিযায়নের পথে অল্প সময়ের জন্য এদেশে ওরা যাত্রা বিরতি করে ও বসন্তে অর্থাৎ ফেব্রয়ারি থেকে মার্চে মূল দেশে ফিরে যাওয়ার সময়ও আরেকবার এদেশে যাত্রা বিরতি করে।

3.1.5.2     পরিযায়ী পাখি

এবার পাখির পরিযায়ন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। পরিযায়ণ হলো একটি নিয়মিত মৌসুমী স্থানান্তর যা সচরাচর তার প্রজনন এলাকা ও শীতের আবাসের মধ্যে হয়ে থাকে। মেরু গাংচিল তার প্রজনন ক্ষেত্র উত্তর মেরু থেকে শীতের আবাস দক্ষিণ মেরুতে সবচেয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেয়। ডোরা-লেজ জৌরালি এক উড়নে প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার উড়ন পথ পাড়ি দিয়ে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডে পরিযায়ন করে। প্রধানত দুই ধরনের পাখিরা পরিযায়ণ করে।

প্রথম ধরন হলো সৈকত, নদী, মোহনা ও জলাভ‚মির পাখি। কমবেশি ৮২ প্রজাতির পাখি এই ধরনের অর্ন্তভুক্ত; মোট সংখ্যার হিসেবে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে ওদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এদেশে ওরা মূলত ছয়টি উড়নপথ আবাস্থল, যেমন- হাকালুকি, টাঙ্গুয়া ও হাইল হাওর (বাইক্কার বিলসহ), সোনাদিয়া দীপপুঞ্জ, নিঝুম দ্বীপ (দমার চরসহ) এবং গাঙ্গুইরার চর ছাড়াও রাজশাহীর পদ্মা নদী ও চরাঞ্চল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরইল বিল, যমুনার চর, মেঘনার মোহনা, কাপ্তাই লেক, সুন্দরবন, উপকুলীয় এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। সৈকত ও জলচর পাখিগুলোর মধ্যে বেশকিছু মহাবিপন্ন পাখি রায়েছে। যেমন- চামচঠুঁটো চাপাখি, সোনাজঙ্ঘা, মানিকজোড়, খুন্তে বক, বড়ো ভূতিহাঁস, তিলা সবুজ চাপাখি ইত্যাদি। 

দ্বিতীয় ধরন হলো বনজঙ্গল, বাগান, কুঞ্জবন ও ঝোপঝাড়ের পাখি। প্রায় ১৫৬ প্রজাতির পাখি এই ধরনের অর্ন্তভুক্ত; মোট প্রজাতির হিসেবে এই ধরনের পাখির প্রজাতি সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আর ওদের আশ্রয়স্থল সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন মিশ্র চিরসবুজ বন, কেন্দ্রীয় ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিভিন্ন পত্রঝরা বা শালবন, সুন্দরবন ও উপক‚লীয় বাদা বন, গ্রামীণ বন, ঝোপঝাড়, ঘাসবন ও বাঁশবনজুড়ে বিস্তৃত।

অনেকের ধারনা পরিযায়ী পাখিরা আমাদের খাদ্যে ভাগ বসায়, ওদের মলের মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ নষ্ট করে, বিভিন্ন রোগ ছাড়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই এগুলো শিকার করে খেয়ে ফেলাই ভালো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ঠিক নয়। কারণ পরিযায়ী পাখিরা তো আমাদের কোনো অপকার করেই না বরং প্রকৃতি ও পরিবেশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ওরা আমাদের অনেক উপকার করে। যেমন- কৃষির ক্ষতিকারক পোকমাকড় দমনে সাহায্য করে, ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে, ওদের মল জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে ও মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং পরিবেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশ সূচক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও বর্তমানে এদেশের মানুষের মধ্যে পাখি পর্যবেক্ষণের হিড়িক পড়ে গেছে, যা অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদনমূলক বিষয়। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পরিবেশ-পর্যটনের উন্নয়নে এটি সাহায্য করে যা বিলিয়ন ডলার শিল্প হয়ে উঠেছে। কাজেই ধীরে ধীরে এটি দেশের জন্য জৈব-অর্থনীতির সম্ভাব্য একটি উৎস হয়ে উঠছে। প্রতি বছর এদেশে যে সংখ্যক পরিযায়ী পাখি আসে সেগুলোর মধ্যে ৮টি মহাবিপন্ন, ৬টি বিপন্ন ও ৮টি সংকটাপন্ন প্রজাতি। কাজেই এসব পাখিদের অতিথি না ভেবে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। এ কথা মনে রাখা উচিত যে, এসব পরিযায়ী পাখি শিকার করে ওদের সংখ্যা কমিয়ে দিলে কোনো কোনো মহাবিপন্ন পাখি, এমনকি এদেশ তথা গোটা বিশ্ব থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আর তা নিশচয়ই আমাদের জন্য ভালো হবে না। কাজেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই পরিযায়ী পাখি রক্ষায় সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।

3.1.6    স্তন্যপায়ী

স্তন্যপায়ী (Mammal) হলো মানুষসহ Mammalia শ্রেণীর যেকোন সদস্য, এদের সাধারণত মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত বলে বিবেচনা করা হয়। এই শ্রেণীর অনন্য বৈশিষ্ট্য দুগ্ধদায়ী স্তনগ্রন্থি থেকেই স্তন্যপায়ী শব্দটির উৎপত্তি। বৃহৎ ও জটিল মস্তিষ্কের সুবাদে এরা শিক্ষণ, দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা ও নমনীয় আচরণ প্রদর্শনের ক্ষমতা লাভ করেছে। পাখির মতো স্তন্যপায়ীরাও দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৪,৫০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীর এক-দশমাংশ রয়েছে ভারত উপমহাদেশে। বাংলাদেশে ১২ বর্গে, ৩৫ গোত্রে ১১০ প্রজাতির স্থলভাগের স্তন্যপায়ী এবং একটি বর্গ ও একটি গোত্রে ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী আছে। এদের মধ্যে মাত্র কয়েক গ্রাম ওজন ও কয়েক সেমি মাপের ক্ষুদ্র ছুঁচো ও চামচিকা থেকে ৩ মিটার উচ্চতা ও ৪ মে. টনের বেশি ওজনের হাতি রয়েছে। বলে রাখা ভালো,  নীল তিমি বৃহত্তম স্তন্যপায়ী, দৈর্ঘ্যে প্রায় ৩০ মিটার ও ওজন হয় প্রায় ১৫০ মে. টন।

বাংলাদেশের স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোকে স্থলজ আর জলজ দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। স্থলজ প্রাণী যেমন বিভিন্ন প্রজাতির বানর, হনুমান, বনবিড়াল, হরিণ, শিয়াল, নেকড়ে, চিতাবাঘ, বেজি, বনরুই ইত্যাদি বাস করে বাংলাদেশের বনভূমি জুড়ে। এদের মাঝে সুন্দরবনের বাঘ বেঙ্গল টাইগার এবং দক্ষিণপূর্ব অঞ্চলের এশীয় হাতির খ্যাতি জগৎজোড়া। জলজ স্তন্যপায়ীর মধ্যে বাংলাদেশে দেখা মেলে শুশুক ও কিছু প্রজাতির ডলফিনের। মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদী, উপকূলীয় এলাকা, মোহনা, টেকনাফ, সুন্দরবন এবং সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে ভেসে বেড়ায় এই ডলফিনরা। হঠাৎ হঠাৎ এই পানিতে ভেসে উঠে তিমি মাছও।

বাঘ

বেঙ্গল টাইগার বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের একটি বিশেষ উপপ্রজাতি। বেঙ্গল টাইগার সাধারণত দেখা যায় ভারত ও বাংলাদেশে। এছাড়াও নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও দক্ষিণ তিব্বতের কোন কোন অঞ্চলে এই প্রজাতির বাঘ দেখতে পাওয়া যায়। বাঘের উপপ্রজাতিগুলির মধ্যে বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যাই সর্বাধিক। বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু। এর গায়ে লালচে বর্নের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে। এছাড়া এই বাঘের রয়েছে রাজকীয় চলন ও ক্ষিপ্রগতি। সুন্দরবনের প্রায় সব জায়গাতে এর পদচারনা লক্ষ করা যায়। কখনো সে গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকে বা নদী-খালের পাড়ে হেতাল বা গোলপাতা গাছের নীচে আয়েশী ভঙ্গিমায় বিশ্রাম নেয় অথবা ঘাসের উপর শুয়ে থাকে। কখনও বা সে সাঁতার কেটে খাল বা নদী পারাপার হয় বা সমুদ্র সৈকতের পাড় দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে চলে।

বাঘ নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সীমানায় (territory) বা নিজস্ব রাজত্বে বসবাসকারী নিঃসঙ্গ প্রাণী। মানুষের শংস্রবে আসতে এরা অপছন্দ করে। পরিণত বাঘ শিকার করে এবং একাকী বাস করে। একমাত্র যৌন মিলন অথবা লড়াইয়ের সময় অন্যের সাক্ষাতে আসে। বাঘ তার নিজস্ব সীমানা রক্ষা করতেই অধিকাংশ সময় ও শ্রম ব্যয় করে, কারণ এটা তাদের টিকে থাকার লড়াই। বাঘিনী জঙ্গলের বিশেষ কোন এলাকার দখল নেয়, যেখানে টিকে থাকার জন্য প্রচুর শিকার পাওয়া যায়। একটি বাঘ এমন একটি এলাকা পছন্দ করে তার বসবাসের জন্য যে এলাকার মধ্যে একাধিক বাঘিনী বাস করে। পুরুষ বাঘ তার এলাকার মধ্যে বসবাসরত বাঘিনীদের উপর প্রজননের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে এবং তার এলাকার মধ্যে অন্য পুরুষ বাঘদের প্রবেশ প্রতিরোধ করতে নিয়মিত টহলদারী অব্যহত রাখে। একটি পুরুষ বাঘের এলাকার মধ্যে দুই থেকে চারটি প্রজননক্ষম বাঘিনী বাস করে। বাঘ এবং বাঘিনী উভয়ই চিহ্ন দিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দেয় যাতে অন্য বাঘ সাবধান হয় এবং তার এলাকায় অনধিকার প্রবেশ না করে। একটি বাঘের বন এলাকায় অন্য বাঘ আসলে মারামারি লেগে যায়। তাই সবাই সবার আবাসিক এলাকা সংরক্ষন করে রাখে। প্রজনন ঋতুতে বাঘ ও বাঘিনী একত্রে চলাফেরা করে। শরৎকাল বাঘের প্রজনন সময়। প্রজনন ঋতু শেষ হলে বাঘ ও বাঘিনী আলাদা হয়ে যার যার আবাস এলাকায় চলে যায়।

একসময় পৃথিবীতে আট প্রজাতির বাঘের দেখা মিলত। কিন্তু, বিংশ শতাব্দিতে এসে মাত্র পাঁচ প্রজাতির বাঘ দেখা যায়। বাকি তিনটি প্রজাতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। গত একশ বছরে চোরাশিকারি এবং আবাস ধ্বংসের কারণে বাঘের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ থেকে মাত্র ৩-৪ হাজারে নেমে এসেছে। এই পরিস্থিতি বাঘের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বাকি পাঁচটি প্রজাতিও আজ খুব বেশি সুখে নেই। বাঘের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হ’ল বন উজাড় হওয়া। প্রতিনিয়ত বন ধ্বংস করা হচ্ছে,ফলে কমে যাচ্ছে বাঘের আবাস ভূমি। চোরা শিকারি বা বাঘ ডাকাতদের হাতে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বহু বাঘ মারা পড়ছে। বাঘের মাথা ও চামড়া বিপুল অঙ্কের টাকায় কালোবাজারীদের কাছে বিক্রি হয়। বাঘের হাড়ও অনেক দামে বিক্রি হয়, কারণ পূর্ব-এশিয়ার অনেক দেশের মানুষ বাঘের হাড় ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরী ঔষধ ব্যবহার করে।

বাঘ রক্ষায় সরকার ইতিমধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যায় সর্বোচ শাস্তি ১২ বছরের কারাদণ্ড ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মানুষ নিহত হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার বিধান রয়েছে।

হাতি

হাতি, ডাঙায় চরে বেড়ানো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণিসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য হাতিকে ফরেস্ট ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়। তাই হাতিকে বনের ইন্ডিকেটর স্পেসিসও বলা হয়। বেজায় ওজন হলেও হাতি কিন্তু সাঁতার কাটতে পারে। ডুবুরিরা যেভাবে একটা পাইপের সাহায্যে নিঃশ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি সাঁতরানোর সময় ওদের শুঁড়ের মাথাটা থাকে পানির ওপরে। হাতি তৃণভোজী প্রাণী। হাতির খাদ্য হচ্ছে বাঁশ, কলাগাছ, ফলদ উদ্ভিদ ও তৃণলতা। দিনের একটা বড় সময় ধরে তারা খাবার সংগ্রহ করে। কখনো কখনো দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ধরেই তারা পাতা, ডাল, মূল এগুলো জোগাড় করে খাওয়ার জন্য। দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে হাতি। এদের স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় ২৫ মাইল। পৃথিবীর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে কম ঘুমায় আফ্রিকার বুনো হাতি। দিন-রাত মিলিয়ে এরা গড়ে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমায়। প্রধানত রাতেই এই সংক্ষিপ্ত নিদ্রা সারে তারা। পৃথিবীতে দুই প্রজাতির হাতি আছে- এশিয়ান প্রজাতি ও আফ্রিকান প্রজাতি। আফ্রিকান হাতিরও আবার দুটি প্রজাতি আছে- আফ্রিকান ফরেস্ট এলিফ্যান্ট আর আফ্রিকান বুশ এলিফ্যান্ট। বাংলাদেশের হাতি এশিয়ান প্রজাতির। আফ্রিকান প্রজাতির হাতি পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েরই দাঁত গজায়। কিন্তু এশিয়ান প্রজাতির ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতির দাঁত গজায়।

বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা, কক্সবাজার, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, টেকনাফ, হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অল্প সংখ্যক বন্যহাতি দেখা যায়। হাতির জন্য প্রয়োজন বিশাল বিচরণক্ষেত্র আর দরকার পর্যাপ্ত খাবার, পানি ও বিশ্রামের জায়গা। হাতিকে বন্য পরিবেশ থেকে বিলুপ্তি রোধে সরকারি-বেসরকারি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা আজ বড় বেশি প্রয়োজন। হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন হাতি-মানুষ দ্বন্দ্বপ্রবণ এলাকায় ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ গঠন, বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মশালা, লোকালয়ের সীমানা বরাবর হাতির অপছন্দনীয় খাদ্যের বাগান (যেমন- কাঁকরল, তিতা করলা, মরিচ ইত্যাদি) সৃজন, বনের সীমানার অভ্যন্তরে হাতির খাদ্যোপযোগী বাগান সৃজন, চুনতির অভ্যন্তরে বড় হাতিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় সোলার ফেন্সিং নির্মাণ, হাতি চলাচলের রাস্তা নির্দেশক ও জনসচেতনতামূলক নির্দেশিকা বোর্ডসহ বিবিধ কার্যক্রম।

হরিণ

হরিণ  Artiodactyla বর্গের Cervidae গোত্রের রোমন্থক একদল স্তন্যপায়ী। গোত্রের সব সদস্যই স্বভাব ও গড়নের দিক থেকে প্রায় অভিন্ন। পুরুষ হরিণের মাথায় থাকে এক জোড়া শিং। এগুলি প্রথমে কোমল ভেলভেট-এর মতো রোমশ চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে এবং পরে পরিণত বয়সে চামড়া শুকিয়ে যায় ও এক সময় খসে পড়ে।

বাংলাদেশের কয়েক প্রজাতির হরিণের মধ্যে সাম্বার (Cervus unicolar) বৃহত্তম এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বনে বাস করে। সবচেয়ে সুন্দর ও পরিচিত প্রজাতি হলো চিত্রা হরিণ (C. axis)। এর হলুদ, হালকা বা গাঢ় বাদামি পিঠ জুড়ে থাকে সাদা রঙের গোল গোল ফোঁটা। এদের আবাস প্রধানত সুন্দরবন। এক সময় সিলেটের বনাঞ্চলে নাত্রিনি হরিণ (hog deer, C. porcinus) দেখা গেলেও বাংলাদেশে এটি এখন আর টিকে নেই। মায়াহরিণ (Muntiacus muntjac) আকারে সবচেয়ে ছোট। সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য সবগুলি হরিণের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

খাটোলেজি বানর

খাটোলেজি বা ছোটোলেজি বানর যার ইংরেজি নাম Stumped-tailed Macaque Bear Macaque. Cercopithecidae গোত্রের বানরটির বৈজ্ঞানিক নাম Macaca arctoides. বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন বানর প্রজাতিটি এদেশে এখন তথ্য অপ্রতুল শ্রেণিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও এরা ভারতের সাত রাজ্য (আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম), মিয়ানমার, চীন, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বাস করে।

প্রাপ্তবয়স্ক খাটোলেজি বানরের দেহের দৈর্ঘ্য ৪৮.৫-৬৫ সেন্টিমিটার ও লেজ ৩.২-৬.৯ সেন্টিমিটার; ওজন ৭.৫-১০,২ কেজি। মুখমণ্ডল উজ্জ্বল গোলাপি বা লাল যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হয়ে প্রায় কালো রং ধারণ করে। এ ছাড়া সূর্যের আলোতেও কালো হতে পারে। লম্বা, ঘন ও গাঢ় বাদামি লোমে এদের পুরো দেহ আবৃত থাকে, তবে মুখমণ্ডল ও খাটো লেজটি লোমশূন্য থাকে। সদ্য জন্মানো বাচ্চার রং সাদা থাকে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে গাঢ় হয়ে যায়। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দাড়ি থাকে।

খাটোলেজি বানর আর্দ্র ও মিশ্র চিরসবুজ বনের গহিনে বাস করে। যদিও চার যুগের বেশি সময় ধরে এদের এদেশে দেখা যায়নি। তারপরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম এবং মিয়ানমার সংলগ্ন সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের গভীর বনে এদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দিবাচর, বৃক্ষবাসী ও ভূমিচারী এই বানরগুলো লাজুক হলেও ভীতু নয় মোটেও। এরা পুরুষ, স্ত্রী, বাচ্চাসহ ৫ থেকে ৬০টির দলে বাস করে। মূলত ফলখেকো হলেও বীজ, ফুল, পাতা, শিকড়, মিঠাপানির কাকড়া, ব্যাঙ, পাখি, পাখির ডিম, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়।

সচরাচর অক্টোবর থেকে নভেম্বরে এরা প্রজনন করে। স্ত্রী বানর চার বছর বয়সে প্রজনন উপযোগী হয় ও প্রায় ১৭৭ দিন গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চা প্রসব করে। স্ত্রী বানর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত প্রজননক্ষম থাকে। যদিও প্রকৃতিতে এদের আয়ুষ্কাল ১০-১২ বছর, তবে আবদ্ধাবস্থায় ৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

রেসাস বানর

Rh-ফ্যাক্টর, আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দ। সাধারণত ব্লাড গ্রুপ Rh+ নাকি Rh- এই ফ্যাক্টরটি যেই জিনগুলোর উপর নির্ভরশীল সেই সম্পূর্ণ ধারণাটি এসেছিলো রেসাস বানরকে নিয়ে গবেষণা করেই। বৈজ্ঞানিক নাম Macaca mullata এবং গোত্র Cercopithecidae

রেসাস বানর বিপন্ন একটি স্তন্যপায়ী, প্রাইমেট বর্গের প্রাণী। বাংলাদেশে তিন প্রজাতির লম্বা লেজযুক্ত রেসাস বানর পাওয়া যায়। IUCN রেসাস বানরকে মহাবিপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে। তাদের বসবাসের স্থান ধ্বংস করা, বনায়ন ধ্বংস করা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন আসার কারণে এই প্রাণীটির সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।

বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের তীরে মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ও ইন্দোনেশিয়ায় অনেক রেসাস বানর পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালের দিকে চকোরিয়া সুন্দরবনে ২৫৩টি রেসাস বানর দেখা গেছে (১৯৮০, ড. ফরিদ আহসান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। তখন সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অবস্থা বেগতিক ছিলো না।

রেসাস বানর খুব-ই বুদ্ধিমান একটি প্রাণী। উক্ত প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা প্রাইমেট বর্গের প্রাণীদের পূর্বপুরুষদের একটি ধারণা দেয়। তারা পাথরকে হাতুড়ি হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজে যেমন: শক্ত খোলসের কোনো ফল বা শামুক ভাঙ্গা।

উক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বিলুপ্তি থেকে মুক্ত করতে নানান সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। রেসাস বানরদের বসবাসের জন্যে সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে পারলে ও তা বজায় রাখতে পারলে অবশ্যই তাদের আবার পরিবেশে ফিরিয়ে আনা যাবে বলে ধারণা করা যায়।

উল্লুক

উল্লুক হলো গিবন (হাইলোবাটিডি) পরিবারের দুইটি প্রজাতির প্রাণীর সাধারণ নাম। এরা লেজবিহীন বানরের ন্যায় দেখতে এক প্রাণী, হাতগুলো পায়ের চেয়ে অনেক লম্বা।সাধারণত থে-উ,হু-উ,হো-কো-উ ইত্যাদি স্বরের একটানা ও যৌগিক স্বরে ডাকে আর এই জন্যই এদের নাম উল্লুক।পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহের (মেঘালয়ের তুরা পাহাড় সংলগ্ন বালিকুরি জঙ্গলের বনাঞ্চলে) এরা বসবাস করে।

উল্লুক গিবন জাতের প্রাইমেটদের মধ্যে আকারে দ্বিতীয় বৃহত্তম। বৃহত্তমটি সিয়ামাং। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ হতে ৯০ সেন্টিমিটার, এবং ওজন ৬ হতে ৯ কেজি। পুরুষ উল্লুক আর মেয়ে উল্লুকের আকার সমান হলেও এদের গায়ের রঙে বেশ পার্থক্য রয়েছে। পুরুষদের গায়ের রঙ কালো কিন্তু সাদা ভ্রু রয়েছে আর অন্যদিকে মেয়ে উল্লুকের সারা গায়ে আছে ধূসর বাদামী লোম।এছাড়াও মেয়ে উল্লুকের চোখ আর মুখের চারপাশে গোল হয়ে সাদা লোমে আবৃত থাকে যা অনেকটা মুখোশের ন্যায় দেখা যায়।

উল্লুকরা মূলত বিভিন্ন ফল ও ডুমুর খায়।এছাড়াও পোকামাকড়, কচি পাতাও খেয়ে থাকে। এরা সাধারণত সামাজিক হয়ে থাকে এবং পরিবারে বাবা ও মা উল্লুকসহ আরও তিন চারটি উল্লুক বা এরও বেশি থাকে।উল্লুক পরিবারগুলো নিজেদের এলাকা ও সীমানা রক্ষা করে চলে।এরা উঁচু গাছের মাথায় থাকতে পছন্দ করে।

এদের ক্ষেত্রে প্রায় ছয়/সাত মাসের গর্ভাবস্থা শেষে শিশু উল্লুকের জন্ম হয়। জন্মের সময় এদের গায়ে ঘোলাটে সাদা লোম থাকে। ছয় মাস পর তা লিঙ্গ অনুসারে কালো বা বাদামি ধূসর রং ধারণ করে। জন্মের ৮ থেকে ৯ বছর পর একটি উল্লুক প্রাপ্তবয়স্ক হয়। উল্লুকের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর।

বিশ্বে ১৯ ধরণের উল্লুক থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় তিনটি প্রজাতি দেখা যায়।বাংলাদেশে মূলত ওয়েস্টার্ন হোলক গিবন বা পশ্চিমা উল্লুক দেখা যায়।বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে উল্লুক বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশে অবস্থিত লাউয়াছড়া বনে যেখানে দুইদশক আগেও কয়েক হাজার উল্লুক দেখা যেতো,তা বর্তমানে একশোর নিচে চলে এসেছে। লাউয়াছড়া ও তার আশেপাশের বনে মোট ১৬ টি উল্লুকের পরিবার রয়েছে। নির্বিচারে বন নষ্ট করার ফলে উল্লুকের বাসস্থান ও খাদ্যসংকট সৃষ্টি এদের সংখ্যা হ্রাসের অন্যতম কারণ।তাই উল্লুককে বাচাঁতে দরকার আমাদের সবার সচেতনতা।

মেছোবিড়াল

মেছোবিড়াল (Fishing Cat) বাংলাদেশের একটি সংকটাপন্ন প্রাণী। বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus

এবং পরিবার Felidae। এরা হাওর অববাহিকা, উত্তরাঞ্চলের চলনবিল, দক্ষিণের ম্যানগ্রোভ ও জলাভূমি অঞ্চলে বসবাস করে। এরা মূলত জলাভূমি থেকে মাছ শিকার করে। কিন্তু জলাভূমি ধ্বংসের কারণে এরা সংঘাতময় প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে, কারণ তারা খামার থেকে মাছ শিকার করতে বাধ্য হচ্ছে।

ইরাবতী ডলফিন

ইরাবতী ডলফিন একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। সমগ্র বিশ্ব থেকে প্রাণীটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে গেলেও, বিশ্বের মোট ইরাবতী ডলফিনের ৮০ শতাংশ এখনো বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Orcaella brevirostris এবং গোত্র Delphinidae। ইরাবতী ডলফিন নদীর পানি থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের লোনা পানিতেও অভিযোজিত এবং বসবাস করতে সক্ষম। এদের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে, আন্দামান সাগরে, থাইল্যান্ডের উপসাগরে পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইরাবতী নদীতে এদের পাওয়া যায় এবং উক্ত নদীর নাম অনুসারেই এদের নামকরণ হয় “ইরাবতী ডলফিন”। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পানিতেও ইরাবতী ডলফিনের দেখা মেলে। বাংলাদেশে সুন্দরবন ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার মিলিত অববাহিকায় ইরাবতী ডলফিন দেখা যায়। এদের গায়ের রং নীলাভ-ধূসর রঙের। প্রানীটির মুখ ভোঁতা, ছোট চঞ্চু ও ছোট পাখনা বিদ্যমান। এদের খাদ্য মাছ এবং খুব-ই চতুরতার সাথে তারা জেলেদের জাল ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে।

বাদুড়

বাদুড় (Pipistrellus savii) স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা স্বাধীনভাবে উড়তে সক্ষম। ছোট কালো লোমে আবৃত pipistrelle যাকে বাংলায় “চামচিকা” নামে আমরা চিনি তা বাদুড়ের-ই একটি জাত। বাদুড় স্বাধীনভাবে উড়তে পারে তবে বাদুড়ের দৃষ্টিশক্তি খুবই কম এবং তারা শব্দতরঙ্গের প্রতিধ্বনি সৃষ্টির মাধ্যমে চলাচল করে। শুধু তাই নয় শিকার করা, আত্মরক্ষা, উড়া সব কাজেই এই প্রাণীটি প্রতিধ্বনির ব্যবহার করে।  এরা ডিম পাড়ে না। অন্য সকল স্তন্যাপায়ী প্রাণীর মতন তারা বাচ্চা প্রসব করে ও দুগ্ধপান করায়। বাদুড় ফল, নেকটার, পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। কিছু ধরণের বাদুড় আছে যারা রক্ত খেয়ে থাকতে পারে।

বাদুড় নিজে রোগ না ছড়ালেও, বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। নিপা ও ইবোলা ভাইরাস তার উদাহরণ। বাদুড় থেকে মানুষে সরাসরি ভাইরাস সংক্রমণ করে কিনা এই বিষয়ে এখনো স্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এটা স্পষ্ট যে বাদুড়ের মাংস খাওয়া, বাদুড়ের বাসস্থান নষ্ট করার মাধ্যমে বাদুড়ের মত বন্যপ্রাণী মানবসমাজে ঢুকে যাচ্ছে যা সম্ভবত বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে। কারণ যত বাস্তুতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটছে তত সংক্রমণকারী ভাইরাসেরা নতুন বাহকে নিজেদের অভিযোজিত করার চেষ্টা করে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর-ই নিপা ভাইরাসের সংক্রমণে অনেকে মৃত্যুবরণ করে। মূলত খেজুরের রস নির্দিষ্ট তাপে ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে না খাওয়ার জন্যে এটি হয় কারণ বাদুড়ের বিভিন্ন প্রজাতি যারা খেজুর গাছে বাস করে, সেই প্রাণীর লালা ও মল-মূত্রে নিপা ভাইরাস থাকতে পারে।

বাদুড়ের যে অপকারিতা রয়েছে তা ঠিক নয়, বাদুড় প্রতিরাতে গড়ে ৫০০-৩০০০ পোকামাকড় খেয়ে ফেলে। ফলে, বাদুড় একটি প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে কাজ করে। যদিও বর্তমানে গাছপালা কমে যাওয়ার কারণে বাদুড়ের বসবাসের স্থানেও ঘাটতি পড়ছে যা পরবর্তীতে পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে।

3.2    বাস্তুতন্ত্রে বন্যপ্রাণীর অবদান

বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষার্থে সকল মেরুদন্ডী এবং অমেরুদন্ডী প্রাণী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রত্যেকের বাস্তুতন্ত্রে আলাদা আলাদা ভূমিকা রযেছে। পরস্পরের অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রাণিদের মাঝে নানারকম আদান-প্রদান দেখা যায় যা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো প্রজাতির জন্যে ক্ষতিকর কিংবা লাভজনক হতে পারে। তবে এই আন্তঃসম্পর্ক জালের ফলে ভারসাম্য রক্ষা হয়। কোনো একটি উপাদানের পরিবর্তন কিংবা বিলুপ্তির ফলে পুরো বাস্তুতন্ত্রে এবং ভবিষ্যতে সমস্ত পরিবেশেই খারাপ প্রভাব পড়ে।

3.2.1    খাদ্য শৃঙ্খল, খাদ্য জাল ও খাদ্য পিরামিড

উৎপাদক জীব যেমন উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণ করে কিছু প্রথম স্তরের খাদক, যেমন ফড়িং। আবার ফড়িং খেয়ে জীবন ধারণ করে দ্বিতীয় স্তরের খাদক ব্যাঙ, ব্যাঙকে আবার তৃতীয় স্তরের খাদক সাপ খায়, আর সাপকে খায় সর্বোচ্চ স্তরের খাদক বাজপাখি। এই বাজপাখি মৃত্যুর পর বিয়োজক তথা মৃতভোজী জীব যেমনঃ ছত্রাক বাজপাখির দেহে বিয়োজন বা পচন ঘটায়। এভাবে উৎপাদক জীব থেকে শীর্ষে থাকা সর্বোচ্চ স্তরের খাদক ও বিয়োজক বা পচনকারীতে সমাপ্ত হওয়া পারস্পরিক রৈখিক সম্পর্ককে খাদ্যশৃঙ্খল বলে। খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায় বিভিন্ন জীব খাদ্যের জন্য একে অপরের সাথে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত। খাদ্য শৃঙ্খলের ধাপগুলিকে খাদ্যস্তর বলে।

এখন, একটি প্রাণিকে কি শুধু একটি প্রাণিই শিকার করে? না। অন্য অনেক প্রাণিও তো তাকে শিকার করে। আবার সেই প্রাণিটিকেও একাধিক প্রাণি শিকার করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট প্রাণী শুধু একটি খাদ্যশৃঙ্খলেরই অংশ নয়, বরং সে বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খলেরও অংশ হতে পারে, এমনকি বিভিন্ন স্তরেরও। এভাবে, কোনো বিভিন্ন জীবের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের যে জটিল জাল বিস্তৃত, তাকে খাদ্য জাল বলে। একটি খাদ্যজালের অনেকগুলো খাদ্যশৃঙ্খল নিয়ে গঠিত হয়ে। খাদ্য শৃঙ্খল শুধুমাত্র অল্পসংখ্যক জীবের মধ্যকার খাদ্য-খাদকের একমূখী সম্পর্ক। অন্যদিকে বিভিন্ন খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যে প্রাকৃতিক আন্তঃসংযোগগুলো মিলে গঠিত হয় একেকটি খাদ্য জাল।

খাদ্য পিরামিড:

বাস্তুতন্ত্রে অসংখ্য জীবজন্তু ও উদ্ভিদ একসাথে অবস্থান করে এবং এদের খাদ্যাভাস প্রায় একই ধরনের হয় । একই উৎস থেকে এরা নিজেদের খাদ্য জোগাড় করে । বাস্তুতন্ত্রে একটি খাদ্যস্তর থেকে অপর খাদ্যস্তরে শক্তি স্থানান্তরিত হওয়ার সময় কিছু পরিমাণ শক্তি তাপশক্তি রূপে পরিবেশ ফিরে যাওয়ার জন্য পরবর্তী খাদ্যস্তরে মোট শক্তির পরিমাণ কমে যায়। এই কারণে পরবর্তী খাদ্যস্তরে কম পরিমাণ শক্তির স্তানান্তরিত  হয়। ফলে জীবের সংখ্যা কমে যায়। কারণ বেশি সংখ্যক জীবকে পূর্ববর্তী খাদ্যস্তর শক্তির জোগান দিতে সক্ষম হয় না। এই কারণে নিম্ন খাদ্যস্তর থেকে উচ্চ খাদ্যস্তর পর্যন্ত জীবের সংখ্যা, ভর এবং স্থানান্তরিত শক্তিকে পরপর সাজালে যে চিত্র পাওয়া যায় তাকে খাদ্য পিরামিড বলে।

বিজ্ঞানী জি. এলটন (G. Elton,1939) প্রথম বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদক থেকে সর্বোচ্চ খাদক পর্যন্ত জবের সংখ্যা, শক্তি ও ওজনের হ্রাস পাওয়ার এই পিরামিড নিয়ে ধারণা দেন। খাদ্য পিরামিডের সবচেয়ে নীচের স্তরে থাকে উৎপাদক, যারা সংখ্যায় বা পরিমাণে সবচেয়ে বেশি হয় এবং সবচেয়ে শিখরে থাকে সর্বোচ্চ খাদক, যারা সংখ্যায় বা পরিমাণে সবচেয়ে কম থাকে।

বৈশিষ্ট:

বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই কারণে উৎপাদক পিরামিডের নিচে অর্থাৎ ভূমিতে অবস্থান করে। খাদ্য পিরামিডে প্রাথমিক খাদকের স্থান উৎপাদকের ঠিক পরে। প্রাথমিক খাদকের সংখ্যা উৎপাদকের তুলনায় কম হওয়ায় উপরে স্থান পায়। গৌণ খাদক এবং প্রগৌণ খাদক প্রাথমিক খাদকের ঠিক উপরে অবস্থান করে। কারণ এর সংখ্যা প্রাথমিক খাদক এর তুলনায় কম। প্রগৌণ খাদক পিরামিডের শীর্ষে অবস্থান করে। কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য কোন শীর্ষ খাদক পিরামিডের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে থাকে। খাদ্য পিরামিডের প্রতিটি স্তরেই বিয়োজোক অবস্থান করে।

বাস্তুতান্ত্রিক পিরামিড বা খাদ্য পিরামিড প্রধানত তিন প্রকারের হয় । যেমন- জীবের সংখার উপর ভিত্তি করে পিরামিড (Pyramid of Numbers), জীবের ভরের উপর ভিত্তি করে পিরামিড (Pyarmid of Biomass), জীবের শক্তি বা এনার্জির উপর ভিত্তি করে পিরামিড (Pyramid of Energy)

জীবসংখ্যার পিরামিড: কোন বাস্তুতন্ত্রের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে প্রতি স্তরের খাদকের সংখ্যাকে পরপর সাজালে যে পিরামিড পাওয়া যাবে সেটিই জীব সংখ্যার পিরামিড। জীব পিরামিডের ভূমিতে অবস্থান করে উৎপাদক বা  সবুজ উদ্ভিদ। পরবর্তী খাদ্যস্তরে ( যেমন- প্রথম শ্রেণীর খাদক, দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক, তৃতীয় শ্রেণীর খাদক) জীবের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। কোন একটি খাদ্যস্তরের জীবের সংখ্যার ওপর পরবর্তী খাদ্যস্তরের জীবের সংখ্যা নির্ভর করে।

যেমন: চারণভূমিতে বা তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্রে ঘাসের তুলনায় তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা কম। তৃণভোজী প্রাণীদের যেহেতু মাংসাশী প্রানীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে একারণে মাংসাশী প্রাণীর সংখ্যা তৃণভোজী প্রাণির সংখ্যার তুলনায় কম হয়। মাংসাশী প্রাণীদের ওপর যে সকল প্রাণী নির্ভরশীল অর্থাৎ মাংসাশী প্রাণীদের যে সকল প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা মাংসাশী প্রাণীর তুলনায় কম হয়।

জীবভরের পিরামিড বা বায়োমাস পিরামিড: জীবভরের পিরমিড বোঝার আগে আমাদের জানতে হবে জীবের শুষ্ক ভর বা Dry Weight কী। কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে পানির পরিমান সরিয়ে ফেললে যে ভর পাওয়া যাবে, সেটিই ওই জীবের শুষ্ক ভর বা Dry Weight। এই শুষ্ক ভর কোন জীবের নমুনা ভর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।  খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরের জীবের এই শুষ্ক ভরকে পরপর সাজালে যে পিরামিড পাওয়া যায় তাকে জীবভরের পিরামিড বলে।

দেখা গেছে, কোন একটি খাদ্য শৃঙ্খলের একটি খাদ্যস্তরের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জীবভর পরবর্তী খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়। এই কারণে উৎপাদকের তুলনায় প্রথম শ্রেণীর খাদকের জীবভর কম হয় এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদকের  জীবভর প্রথম শ্রেণীর খাদকের তুলনায় কম হয়। যেমন- বনভূমির বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদকের জীবভর সর্বাপেক্ষা বেশি হয় এবং সর্বোচ্চ স্তরের খাদকের জীবভর সবচেয়ে কম হয়।

শক্তির পিরামিড বা এনার্জি পিরামিড: বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক বা সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করে। যে পরিমান শক্তিকে সবুজ উদ্ভিদ নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ করে তার কিছু পরিমাণ তার শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-কলাপের জন্য ব্যয় করে। কিছু অংশ পরবর্তী খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ উৎপাদক যে পরিমাণ সৌরশক্তি ব্যবহার করে নিজের জন্য সবটাই কিন্তু পরবর্তী খাদ্যস্তরের স্থানান্তরিত হয় না।

দেখা যায় যে, একটি খাদ্যস্তর থেকে পরবর্তী খাদ্যস্তরে শক্তির স্থানান্তর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কমে যায়। এই কারণে উৎপাদক থেকে প্রাথমিক খাদকে স্থানান্তরিত শক্তির পরিমাণ কম হয়। গৌণ খাদকে প্রাথমিক খাদক যে পরিমাণ শক্তি অর্জন করে তার থেকে কম পরিমাণে স্থানান্তরিত হয়। উৎপাদক থেকে শক্তি বিভিন্ন খাদ্যস্তরের এই স্থানান্তরকে যে পিরামিডের মাধ্যমে দেখানো হয় তাকে শক্তির পিরামিড বলে।

3.2.2    বন্যপ্রাণির বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসম্পর্ক

পরজীবিতাঃ বাস্তুতন্ত্রে কোনো প্রজাতি ভিন্ন প্রজাতিভুক্ত জীবের দেহে জীবনের এক বা একাধিক পর্যায়ে বাস করতে পারে। এধরনের সম্পর্ককে পরজীবিতা (Parasitism) বলা হয়। পরজীবিতায় বেশিরভাগ সময়ই পোষক জীব ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন- উঁকুন।

সহভোজিতাঃ যখন দুইটি প্রজাতির আন্তঃসম্পর্কের ফলে একটি প্রজাতি লাভবান হয়, কিন্তু অপর প্রজাতির তেমন কোনো লাভ বা ক্ষতি কিছুই হয়না, তখন তাকে সহভোজিতা (Commensalism) বলে। যেমন- গৃহপালিত পশুর গায়ে বসে থেকে বিভিন্ন পাখি পোকামাকড় খায়, যা সহভোজিতার একটি উদাহরণ।

পারস্পরিকতাঃ আন্তঃসম্পর্কের ফলে উভয় প্রাণিই যখন উপকৃত হয়, তখন তাকে পারস্পারিকতা (Mutualism) বলে। যেমনঃ ফুল এবং মৌমাছি। মৌমাছি ফুল থেকে নেক্টার আহরণ করে জীবনধারণ করে, আর মৌমাছির মাধ্যমে ফুলের পরাগায়ন ঘটে। এভাবে উভয়ই উপকৃত হয়।

মিথোজীবিতাঃ যখন দুইটি ভিন্ন প্রজাতির মাঝে দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কের ফলে দুই প্রজাতিই উপকৃত হয় তাকে মিথোজীবিতা বলা হয়। যেমনঃ লাল কাঁকড়া এবং ইস্ট। ইস্ট কাঁকড়ার দেহকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে ঈস্টের বেঁচে থাকার জন্য লাল কাঁকড়ার দেহ আদর্শ আবাসস্থল।

3.3    বন্যপ্রাণীর রোগের বিস্তার, সংক্রমণ ও প্রতিরোধ  (Wildlife Diseases’ Spread, Surveillance and Prevention)

মানুষ ও প্রাণী উভয়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে পশু-পাখি থেকে যে সব রোগ মানুষের মাঝে সংক্রমিত হচ্ছে বা হতে পারে তা নিয়ে বিশেষভাবে রোগতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ, জরিপ ও গবেষণা শুরু হয়েছে। কিন্ত বাংলাদেশে এ নিয়ে এখনো তেমন কোণ কাজ হয়নি। আমরা অনেকেই জানি না কোন কোন পশুপাখির রোগ মানুষের মাঝে সংক্রমিত হতে পারে বা হচ্ছে।

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীরা বিভিন্ন রোগের শিকার হতে পারে। এই রোগগুলো প্রাকৃতিকভাবে হতে পারে, আবার মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলেও হতে পারে। বন্যপ্রাণিদের রোগের কিছু সাধারণ উদাহরণ হল:

  • অ্যানথ্রাক্স: এটি একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ যা গরু, ছাগল, ভেড়া, এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
  • রেবিস: এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা কুকুর, বাদুর, এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
  • ক্যানাইন ডিসটেম্পার: এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা কুকুর, শেয়াল, এবং অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
  • ফাউল পক্স: এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা মুরগি, হাঁস, এবং অন্যান্য পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
  • নিউক্যাসল ডিজিজ: এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ যা মুরগি, হাঁস, এবং অন্যান্য পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

জুনোটিক রোগ বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু (pathogen) দ্বারা সংঘটিত হয়। এসকল রোগজীবাণু ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায় যথাঃ ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, রিকেটশিয়া ও পরজীবী।

ব্যাকটেরিয়া (Bacteria)

ব্যাকটেরিয়া এককোষী, প্রোক্যারিওট জীব যা কোষ প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। এদের কোন নিউক্লিয়াস বা অন্যান্য ঝিল্লিবদ্ধ অঙ্গাণু নেই। ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন আকার, আকৃতি এবং রঙে পাওয়া যায়। 

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ:

  • খাদ্যবাহিত সংক্রমণ: দূষিত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
  • জলবাহিত সংক্রমণ: দূষিত জল পান করার মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
  • শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ: দূষিত বাতাস শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
  • ত্বকের সংক্রমণ: দূষিত ত্বকের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।

অসংখ্য ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে শুধু যেগুলো এদেশে কোনো না কোনো রোগের জন্য দায়ী – কক্কাই, মাইকোব্যাকটেরিয়া, এক্টিনোমাইসিস, স্পেরবাহী ব্যাকটেরিয়া, বেসিলাই, পাস্তুরেলা ইত্যাদি।

ভাইরাস

ভাইরাস – এমন একটি শব্দ যা আমাদের সবার কাছেই চেনা। কখনও ঠান্ডা লাগে, কখনও ডেঙ্গু জ্বর, কখনও আবার করোনা – ভাইরাসই এসব রোগের জন্য দায়ী। ভাইরাস হলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র, জীবন্ত নয় এমন কণিকা। এরা এতই ক্ষুদ্র যে মানুষের চোখে দেখা যায় না। নিজে থেকে বাঁচতে বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। কিন্তু কোনো প্রাণীর কোষের ভিতরে ঢুকে পড়ে সেই কোষের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। নিজের কপি তৈরি করে, সেই কোষকে ধ্বংস করে ফেলে। আর এইভাবেই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

তবে সব ভাইরাসই খারাপ না। কিছু ভাইরাস আমাদের উপকারও করে। যেমন, কিছু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে, আবার কিছু ভাইরাস জিন থেরাপিতে ব্যবহৃত হয়।

ভাইরাসবাহিত জুনোটিক রোগঃ বার্ড ফ্লু, এন্থ্রাক্স, রেবিস, করোনা ইত্যাদি।

রিকেটশিয়া

রিকেটসিয়া হলো এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া, যা এতটাই ছোট যে সাধারণ আলোক মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না। এরা মাকড়সা, টিক, এবং উকুনের মতো রক্তচোষা প্রাণির দেহে বাস করে। যখন এগুলো কোনো প্রাণিকে কামড়ায়, তখন রিকেটশিয়া রক্তের সাথে প্রাণির দেহে ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশে রিকেটসিয়া দ্বারা সৃষ্ট কিছু সাধারণ রোগ হলো: স্ক্রাব টাইফাস, মিউরিন টাইফাস, মার্সিলিজ ডিজিজ ইত্যাদি।

পরজীবী (Parasite)

পরজীবী হলো এমন এক জীব, যা আজীবন বা জীবনের কোনো নির্দিষ্ট সময় অন্য জীবের (আশ্রয়দাতা) দেহের ভিতরে বা বাইরে বাস করে এবং তার খাদ্য ও পুষ্টি গ্রহণ করে। এই আশ্রয়দাতার ক্ষতি করেই তারা বেঁচে থাকে। পরজীবীরা বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন— জিয়ার্ডিয়া (ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী), পিনবর্ম (আন্ত্রপরজীবী), উকুন, মশা (বহিঃপরজীবী)।

বন্যপ্রাণিদের রোগের প্রতিকারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি হল:

  • টিকা: টিকা দেওয়ার মাধ্যমে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
  • রোগাক্রান্ত প্রাণীদের আলাদা করা: রোগাক্রান্ত প্রাণীদের সুস্থ প্রাণীদের থেকে আলাদা করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
  • পরিবেশের উন্নয়ন: বন্যপ্রাণীদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ।
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি: বন্যপ্রাণিদের রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যপ্রাণিদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এবং জনগণের একসাথে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ।

বন্যপ্রাণিদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমরা যা করতে পারি তা হলোঃ

  • বন্যপ্রাণী না খাওয়া 
  • তাদের সংস্পর্শে না আসা
  • বন্যপ্রাণিদের আবাসস্থল নষ্ট না করা
  • বন্যপ্রাণিদের রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং রোগাক্রান্ত প্রাণী চোখে পড়লে কর্তৃপক্ষকে জানানো।
  • বন্যপ্রাণিদের রোগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার জন্য সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন ও সহায়তা করা।

বন্যপ্রাণিরা আমাদের পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের রোগ হলে তারা যেমন বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে, আবার তাদের থেকে মানুষের মধ্যেও বিভিন্ন রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মানবজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। তাই বন্যপ্রাণিদের বিভিন  রোগ থেকে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

3.4     বিশেষ টপিক

3.4.1    আগ্রাসী বিদেশী প্রজাতি

কোনো প্রজাতি নিজ অঞ্চল ছেড়ে অন্যকোনো অঞ্চলে গিয়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বংশবিস্তার করলে এবং সে অঞ্চলের পরিবেশ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতি করলে তাকে আগ্রাসী প্রজাতি (Invasive species) বলা হয়। যেমন- কচুরিপানা বাইরে থেকে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যে নিয়ে আসা হলেও বর্তমানে তা সংখ্যাবৃদ্ধি করে দেশের বেশিরভাগ জলাধারে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণিদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছারাও, আফ্রিকান মাগুর আগ্রাসী প্রজাতির আরেকটি উদাহরণ। এর উপস্থিতির কারনে জলাশয়গুলোতে ছোট মাছগুলো টিকে থাকতে পারছে না।

3.4.2    পরিযায়ন

ঋতু পরিবর্তন, খাদ্য স্বল্পতা, প্রজনন কিংবা বংশানুক্রমিক ধারার ফলে কোনো প্রজাতি নিজ অঞ্চল থেকে দূরবর্তী কোনো অঞ্চলে গমন করাকে পরিযায়ন বলা হয়। সবচেয়ে পরিচিত পরিযায়নের উদাহরণ হলো পাখির পরিযায়ন। শীতকালে আমরা অসংখ্য পরিযায়ী পাখি দেখি যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঋতু পরিবর্তন কিংবা খাদ্য স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশে আসে।

3.4.3    বিবর্তন

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে ক্রমপরিবর্তন ঘটে, তাকে বিবর্তন বলে। জিনের মিউটেশনের মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে একটি প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা খুবই সামান্য। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলে, অনেকগুলো প্রজন্ম পরে জীবগোষ্ঠীতে সেই পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য হয়ে দেখা দেয়। এমনকি এভাবে একসময় নতুন প্রজাতিও উদ্ভব হয়ে যেতে পারে।

বিবর্তনের ভিত্তি হচ্ছে বংশপরম্পরায় জিনের সঞ্চারণ। এই জিনগুলোর বিভিন্নতার কারণে একটি জীবগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে বংশগত বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য বা প্রকরণ সৃষ্টি হয়। নতুন প্রকরণ উৎপন্ন হয় দুটি প্রধান উপায়ে : ১. জিনগত মিউটেশন বা পরিব্যক্তির মাধ্যমে এবং ২. বিভিন্ন জীবগোষ্ঠী বা প্রজাতির মধ্যে জিনের স্থানান্তরের মাধ্যমে।

দুটি প্রধান মেকানিজম নির্ধারণ করে কোনো প্রজাতির একটি নির্দিষ্ট প্রকরণের সংখ্যা বাড়বে কিনা। প্রথমত, প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিকভাবে একটি জীবগোষ্ঠীর অস্তিত্বের জন্য অনুকূল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও কালক্রমে তা পুরো জীবগোষ্ঠীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। আবার ক্ষতিকর বা কম সুবিধাদায়ক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সদস্যসংখ্যা হ্রাস পায়, ফলে সেই প্রকরণগুলো ধীরে ধীরে বিরল হয়ে যায়। একেই প্রাকৃতিক নির্বাচন বলে।  চার্লস ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস পৃথকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তবে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিবর্তনের জনক চার্লস ডারউইন রচিত ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটি প্রকাশিত হলে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব বিজ্ঞানীমহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। বিবর্তনের আরেকটি মেকানিজম হচ্ছে জেনেটিক ড্রিফট।

3.4.4    জৈবিক উপায়ে বালাই দমন

পরিবেশকে দুষণমুক্ত রেখেও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ফসলের ক্ষতিকারক পোকা ও রোগ বালাইকে দমন করা যায়। উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণ, বালাই সহনশীল জাত ও যান্ত্রিক দমন পদ্ধতি ব্যবহার করে তা করা হয়।

উপকারী পোকামাকড় ও প্রাণী সংরক্ষণঃ ব্যাঙ, চিল, পেঁচা, গুইসাপ, মাকড়সা, গুবড়ে পোকা, বোলতা, ফড়িং প্রভৃতি উপকারী পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণী ক্ষতিকারক পোকা দমনে যথেষ্ট সাহায্য করে। তাই উপকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যায়, যেমনঃ ধান ক্ষেতের আইলে শিম ও শসা জাতীয় ফসল আবাদ করা, জমিতে পরিমিত পরিমাণ পানি রাখা, ফসল কাটার পর আইলে কিছু খরকুটা বিছিয়ে দেওয়া, জমিতে বাঁশের বুষ্টার স্থাপনের মাধ্যমে বোলতা প্রতিপালন করা, বালাইনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিহার করা ইত্যাদি।

বালাই সহনশীল জাতের চাষাবাদঃ এর মাধ্যমে ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ অনেকাংশে রোধ করতে পারা যায়। যেমন -বি আর ২৬ জাতটি সাদা-পিঠ গাছ ফড়িং ও ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধশীল,ব্রি ধান ২৭ জাতটি সাদা পিঠ গাছ ফড়িং এর আক্রমণে প্রতিরোধশীল এবন ব্রি ধান ৩১ জাতটি বাদামি গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণে প্রতিরোধশীল এবং পাতা পোড়া ও টুংরো রোগে মধ্যম প্রতিরোধশীল।

যান্ত্রিক দমন পদ্ধতিঃ এভাবেও বালাই দমন করা যায়, যেমনঃ হাত জালের সাহায্যে পোকা ধরে মারা,আলোর ফাঁদে পোকা ধরা,আক্রান্ত পাতার আগা কেটে দেওয়া,পাখি বসার জন্য ডাল পুঁতা ইত্যাদি।

উপরিল্লিখিত পদ্ধতিগুলোর সাহায্যেও যদি ক্ষতিকারক পোকা- মাকড় ও রোগের আক্রমণ দমিয়ে রাখা সম্ভব না হয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, কেবল তখনই বালাইনাশক সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত। অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বিভিন্ন উপকারী প্রাণী ও বন্যপ্রাণির জীবন হুমকির মুখে পড়বে।

পরিবেশ রক্ষার্থে পরিবেশের উপাদান এবং এদের মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক বোঝা জরুরি। মানবসভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানানভাবে। এর মাঝে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো বন্যপ্রাণির বিলুপ্তি। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ করা বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের জন্য দরকারি। তাই বন্যপ্রাণির জীবতত্ব এবং বাস্তুতন্ত্রে এদের আন্তঃসম্পর্কগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। এদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ রোধ করে একটি সুস্থ পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সকলের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।

3.4.5    বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পরিবহনে সতর্কতা

অনেক সময়েই তোমার ঘরে কোনো বন্যপ্রাণী যেমন সাপ, বাদুড় ইত্যাদি ভুলবশত ঢুকে পড়তে পারে। যেহেতু সাপটি বিষাক্ত হতে পারে, এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণির কামড়েও বিভিন্ন রোগে তুমি আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারো, সেহেতু তোমার উচিত নয় ঐ বন্যপ্রাণিটি ধরতে যাওয়া। আবার একে পিটিয়ে মেরে ফেলাও উচিত নয়। কারণ সেতো কারোর ক্ষতি করেনি। সে শুধুমাত্র ভুল করে এখানে চলে এসেছে। তাই তাকে উদ্ধার করে তার আবাসস্থলে ছেড়ে দিয়ে আসাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত সমাধান। এসকল পরিস্থিতিতে বন্যপ্রাণী ধরে তাকে পরিবহন করে নিয়ে যেয়ে বন্য পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মানুষ রয়েছে বনবিভাগে। এজন্য তোমাদের সকলের উচিত এরকম পরিস্থিতিতে স্থানীয় বনবিভাগকে খবর দেওয়া। তারা এসে বন্যপ্রাণিটিকে উদ্ধার করে বুনো পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে আসবে।

আবার অনেক সময় কোনো বন্যপ্রাণী আহত হয়ে পড়ে থাকতে পারে। অনেকসময় দেখা যায়, বানর বা বিভিন্ন পাখি বৈদ্যুতিক তারে শক খেয়ে আহত হয়ে পড়ে আছে। তাদেরকে তখন উদ্ধার নিকটস্থ পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং বনবিভাগকে খবর দিতে হবে। তারাই তার চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং বন্য পরিবেশে মুক্তির ব্যবস্থা করবে।