তারুণ্য চির দুর্বার, দুরন্ত, দুর্বিনীত ও দুর্দমনীয়। তারুণ্যের উদ্দীপনা, সাহসিকতা, দুর্বার গতি, নতুন জীবন রচনার স্বপ্ন এবং কল্যাণব্রত এসব বৈশিষ্ট্যি প্রতিটি জাতীয় জীবনের চালিকাশক্তি। তাইতো পৃথিবীর সকল দেশে সকল কালে, যুগান্তরে রচিত হয়েছে তারুণ্যের জয়গান। বিখ্যাত সকল কবি সাহিত্যিকগণ তাদের সাহিত্যকর্মে গেয়েছেন তারুণ্যের স্তূতি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজের অভিনন্দনের উত্তরে তাদের উদ্দেশ্যে তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তি ও সম্ভাবনা এবং গৌরবের ইতিহাস নিয়ে একটি কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে রচিত বিখ্যাত অভিভাষণ ‘যৌবনের গান’ এ তিনি লিখেছেন, ‘‘তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। ’’ তারুণ্যের উদাহরণ হিসেবে তিনি আরবের বেদুইন, মহাসমরের সৈনিকের মুখ, কালাপাহাড়ের অসি, কামাল-করিম-মুসোলিনি-সানইয়াৎ লেনিনের শক্তি প্রভৃতি উল্লেখ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের কিশোরকবি খ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তারুণ্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে লিখেছেন ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতা। মূলত প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের জীবনে তারুণ্যে থাকে অপরিসীম সাহস। তাই তারুণ্যের ধর্মই হলো আত্মত্যাগের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া, আঘাত-সংঘাতের মধ্যে সমস্ত দুর্যোগ আর দুর্বিপাক মোকাবিলা করার অদম্য প্রাণশক্তি আর রক্তশপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। প্রাণবন্ত তরুণরা চারপাশের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-পীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, আন্দোলন গড়ে তোলে, ক্ষুদ্ধ হয়ে পৃথিবীর সকল অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। তারুণ্য জানে সুন্দর, শুভ ও কল্যাণের জন্য রক্তদানের পূণ্য। দেশ, জাতি ও মানবতার জন্য যুগে যুগে তারুণ্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছে সমস্ত বিপদ মোকাবেলায়; প্রাণ দিয়েছে দেশ ও জনগণের মুক্তি ও কল্যাণের সংগ্রামে। তাই তারুণ্য স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের এবং সেইসব স্বপ্ন বাস্তবায়নে, নিত্য-নতুন করণীয় সম্পাদনের জন্য নতুন শপথে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যায় দৃঢ় পদক্ষেপে। তদ্রুপ বাংলাদেশের তরুণরাও প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে যোগ্য ও দক্ষ করে বিশ্বদরবারে পরিচিত করছে নতুন উদ্ভাবনা ও টেকসই পৃথিবীর কৌশল ও নিগূঢ় সম্ভাবনা নিয়ে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতা অর্জন পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সকল সংস্কারমূলক আন্দোলনে তরুণ সমাজের ভূমিকা ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে উন্নীতকরণ, বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তরুণদের ভূমিকা প্রশংসীত এবং ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনস্বীকার্য। 

চলো, তোমাদের একটি সত্য ঘটনা বলি। সে অনেকদিন আগের কথা, জাপানের গহীন অরণ্য ও সুবিশাল পর্বতে একপ্রজাতির হায়েনার বসবাস ছিল। সেসকল হায়েনা সুন্দরবনের বাঘেদের মতো হরিণ শিকার ও ভক্ষণ করে বে̐চে থাকতো। কালক্রমে নানাবিধ কারণে জাপানি শিকারিদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হলো এবং শিকারিরা বন্য হায়েনা হত্যা করতে লাগলো। এভাবে ক্রমে মানুষ-হায়েনা দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে এবং বর্তমান সময় হতে ১০০ বছরেরও অধিক সময় পূর্বে জাপানের বুনো পরিবেশ থেকে হায়েনা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। তখন থেকে জাপানের প্রাকৃতিক পরিবেশে হরিণ শিকারের জন্য বাস্তুতান্ত্রিক কোন শিকারি না থাকায় ম্যালথাসের সূত্রমতে বাড়তে থাকে হরিণের সংখ্যা। পরিণামে বর্তমান সময়ে কৃষিজ উৎপাদনে হরিণের উপদ্রব জনিত ক্ষতি নিরাময়ে তাদের গবেষণা ও বাস্তবায়নে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অধিকন্তু, বিঘ্নিত হয়েছে তাদের প্রাকৃতিক ও বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়ছে প্রবলভাবে। বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে তারা অনেক অগ্রগামী হলেও তাদের দেশের বন-বনানী কিংবা মুক্ত পরিবেশে তাই আমাদের দেশ বাংলাদেশের মতো বাঘ, হাতি, হনুমান, উল্লুখ ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব নেই। সঙ্গত কারণে জাপানের তরুণ প্রজন্ম বিদ্যমান বন, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে হয়েছে বদ্ধ পরিকর। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বাংলাদেশি জনগণ সৌভাগ্যবান যে আমাদের বনাঞ্চলে এখনো বাঘ-হাতির ন্যায় বৃহৎ স্থলচর বন্যপ্রাণী রয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে এখনো বাঘ হরিণ শিকার করে এবং হরিণ বনজ লতা-পাতা ও তৃণ ভক্ষণ করে বে̐চে রয়েছে। বিচিত্র পাখি-প্রজাপতি-পতঙ্গের কলরবে মুখরিত আমাদের পরিবেশ। কিন্তু জাপান ১০০ বছর পূর্বে যে সমস্যায় পতিত হয়েছিল তদ্রুপ সমস্যায় আমরাও জর্জরিত হয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে। মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বাংলাদেশে দিনে দিনে ভয়ংকর ‍রুপ ধারণ করছে। পত্রিকা কিংবা খবরে এ বিষয়ে সংবাদ প্রায়শঃ দেখা যায়। আমরা যদি অনতিবিলম্বে আমাদের দেশে বিদ্যমান ও হুমকির সম্মুখিন বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ না করি এবং এর জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা করতে ব্যর্থ হই, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরাও আমাদের মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বন্যপ্রাণী চিরতরে হারিয়ে ফেলব। 

তাই এদেশের তরুণ সমাজকে নিবেদিত হতে হবে বন, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতির তরে। দেশের আপামর জনসাধারণকে সচেতন করা কিংবা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রভৃতি কাজ সফল হবে দেশের তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। পাশাপাশি সকল নাগরিককেই হতে হবে সোচ্চার আর সচেতন। যেখানেই বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হবে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে স্থানীয়দের। সর্বোপরি শিক্ষা, গবেষণা, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং গভীর স্বদেশপ্রেমে উজ্জ্বীবিত আধুনিক স্মার্ট তারুণ্যই একতাবদ্ধ হাতে প্রতিহত করবে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত; সংরক্ষণ করবে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এবং পুনঃরুদ্ধার করবে অবক্ষয়িত অরণ্য। অতএব, নতুন প্রজন্মকে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে, আগামীর সুস্থ পরিবেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন দুরুহ নয়। সেজন্য প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করা আবশ্যক। শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের গল্প, উপন্যাস, ছড়া যেমন হতে পারে প্রকৃতিবান্ধব, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হোক পরিবেশবান্ধব।

7.1 শিক্ষা ও গবেষণা

এই কথা সর্বজনবিদিত যে, শিক্ষা একটি জাতির মেরুদন্ড এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় প্রকারে জনগণকে সার্বিক বিষয়ে সক্ষম করে গড়ে তুলে। শিক্ষার মাধ্যমে সকল বিষয়ে মৌলিক, কারিগরি ও পেশাগত জ্ঞান অর্জনের পাশাপশি জনগণের মানবিক অনুভূতিসমূহ জাগ্রত হয়। এর মাধ্যমে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং সংরক্ষণমূলক ও টেকসই ব্যবহারের মানসিকতার উদ্ভব ঘটে। অন্যথায়, শিক্ষাহীন বা নিম্নশিক্ষিত জাতির জন্য যেকোন কল্যাণকর উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যুবসিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। 

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ (Community Participation in Wildlife Conservation) নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সুশিক্ষিত এবং স্ব-শিক্ষিত জনগণ ব্যতিরেকে এর বাস্তবায়ন দুষ্কর। উন্নত রাষ্ট্র সমূহে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ও ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ (Community Participation in Wildlife Conservation) নিশ্চিত করতে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা, এমনকি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ও তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের উক্ত গবেষণায় অংশগ্রহণ এর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সূচন শহরে স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইকোলজি, যেখানে নিরলসভাবে জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করছে ৭০০ এর অধিক প্রফেশনাল বিশেষজ্ঞ দল। বলা বাহুল্য যে, শিক্ষা ও গবেষণা জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পরিবেশগত গতিশীলতা অনুধাবন এবং সংরক্ষণের কৌশল ও নীতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

প্রথমত, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমগুলি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং বিভিন্ন প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের হুমকির বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করে। স্কুল, জাদুঘর, প্রকৃতিকেন্দ্র স্থাপন এবং আউটরিচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া, বন্যপ্রাণীর জনসংখ্যার ডাইনামিকস এবং পরিবেশগত পরিবর্তন জনিত প্রভাবসহ বাস্তুতন্ত্রের জটিলতাগুলি বুঝতে সক্ষম হন। এই জ্ঞান কার্যকর সংরক্ষণ কৌশল ডিজাইন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

তৃতীয়ত, প্রমাণ-ভিত্তিক সংরক্ষণ কৌশল উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে শিক্ষা এবং গবেষণা মৌলিক ভিত্তি প্রদান করে। বিভিন্ন প্রজাতির বন্টন, জনসংখ্যার বিস্তার এবং বাসস্থানের উপর তথ্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা সংরক্ষণের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করতে পারেন এবং করণীয়সমূহ সুপারিশ করতে পারেন। 

চতুর্থত, স্থানীয় সম্প্রদায়, সংরক্ষণ সংস্থা এবং সরকারের সক্ষমতা তৈরিতে শিক্ষা এবং গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানভিত্তিক কৌশল নির্বাচন (field techniques), উপাত্ত বিশ্লেষণ (data analysis) এবং বিভিন্ন ধরণের সংরক্ষণ পরিকল্পনা (conservation planning) ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে জনগণকে বন্যপ্রাণী এবং প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে সক্ষম করে গড়ে তোলা সম্ভব। 

উদাহরণস্বরুপ, সুন্দরবনের মিঠাপানির কুমির সংরক্ষণে শিক্ষা এবং গবেষণার ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখ করা যায়। যেহেতু সুন্দরবনের মিঠাপানির কুমির বর্তমান সময়ে নানাবিধ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তাদের সংরক্ষণে নিরলস কাজ করে চলেছেন দেশী-বিদেশী একঝাঁক তরুণ গবেষক ও স্থানীয় বনকর্মী। এক্ষেত্রে তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমসমূহ সুন্দরবনের মিঠাপানির কুমির সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সর্বসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমূহের মধ্যে স্কুলে প্রচার কার্যক্রম, কমিউনিটি ওয়ার্কশপ এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের বাসা বাঁধার আচরণ, স্থানান্তরের ধরণ, জনসংখ্যার গতিশীলতা এবং তাদের বেঁচে থাকার উপর হুমকিসমূহ প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করা যেতে পারে। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং এর সাহায্যে তাদের গতিবিধি অধ্যয়ন করে তাদের খাদ্য এবং বাসা বাঁধার আবাসস্থল চিহ্নিত করা যায়। অতঃপর, শিক্ষা এবং গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সরকার সুন্দরবনের মিঠাপানির কুমির সংরক্ষণের নিমিত্তে সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা ঘোষণা এবং টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনার মতো উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারে। 

বাংলাদেশে বন, বনভূমি, বনের বৃক্ষ, প্রাণী ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে বিভিন্ন আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা ইত্যাদি। তথাপি এদেশে অদ্যাবদি অবৈধভাবে বন উজাড় ও বন্যপ্রাণী শিকার রোধ করা দুরুহ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো আইনের বিধানসমূহ সম্পর্কে সকলে সঠিকভাবে অবগত নয়। অধিকন্তু, পৃথিবীর স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকার জন্য বন্যপ্রাণীর প্রয়োজনীয়তা ও আবশ্যিকতা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ সচেতন নয়। তাই বন ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সকল মহলকে সচেতন করে তোলা এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার পাশাপশি দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছে বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরা প্রয়োজন। এই তথ্যপ্রমাণসমূহ সংগ্রহ করতে এবং অনুসন্ধানী গবেষণার মাধ্যমে বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এদেশের বিজ্ঞানী, গবেষক, গণমাধ্যমকর্মী ও বনবিভাগের কর্মীরা। বাংলাদেশে এমন অনেক প্রাণির অস্তিত্ব রয়েছে যারা গভীর বনে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসবাস করতে পছন্দ করে। আবার অনেক প্রাণী আছে যাদের একসময় মনে করা হতো দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সম্প্রতি বনের গহীনে কোথাও কোথাও আবার তাদের দেখা গিয়েছে; অর্থাৎ তারা আবার বনভূমিতে ফিরে এসেছে। আবার অনেক প্রাণী রয়েছে যাদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন এতটাই কম যে নিজের প্রজাতির শেষ গুটিকয়েক সদস্য কোনোমতে টিকে আছে। 

7.2 বন্যপ্রাণী জরিপ এবং মহাবিপন্ন, বিপন্ন ও সংকটাপন্ন প্রাণীর মনিটরিং: আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি

বন্যপ্রাণী গবেষণার ব্যপ্তি যত বাড়ছে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার সহজলভ্য ও ফলপ্রসু হচ্ছে, ততই নিত্যনতুন প্রজাতির সন্ধান মিলছে, যাদের সম্পর্কে মানবজাতি এর আগে কিছুই জানতো না। তুমি কি কল্পনা করতে পারো, এখনও তোমার আশেপাশের জঙ্গলে হয়তো এমন কোনো নতুন বন্যপ্রাণীর প্রজাতি লুকিয়ে আছে, যার সম্পর্কে আমরা কেউই কিছু জানি না! যেমন, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ২০২১ সালে নতুন ব্যাঙের প্রজাতি আবিষ্কার করেন বন্যপ্রাণী গবেষক মার্জান মারিয়া ও হাসান আল-রাজী। তারা এই ব্যাঙের নাম দিয়েছেন ‘সিলেটের লাল চোখ ব্যাঙ (Sylheti Litter Frog)’। নতুন এই ব্যাঙের শরীরের রং ধূসর থেকে কালচে এবং শরীরে কালো ছাপ রয়েছে। এই রং তাদেরকে ঝরা পাতার সাথে মিশে থাকতে সাহায্য করে। এদের পেছনের পা তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ায় খুব বেশি জোরে লাফাতে পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে এদের চোখের ওপর অর্ধেক লাল রঙের, যেখানে আলো পড়লে উজ্জ্বল প্রতিফলন তৈরি হয়। 

এছাড়াও ২০২০ সালে হাতিয়া উপকূলের জলাভূমিতে নতুন প্রজাতির পলিকীটের সন্ধান পেয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন। তিনি এর বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছেন Glycera sheikhmujibi. এর পূর্বে তিনি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে নেফটাইস বাংলাদেশি, নিউমানিয়া নোবিপ্রবিয়া ও অ্যারেনুরাস নামক আরও তিনটি নতুন অমেরুদণ্ডী প্রজাতি আবিষ্কার করেন। শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহসান হাবীব সুন্দরবনের দুবলারচরে নতুন প্রজাতির মাছের সন্ধান পেয়েছেন। এভাবে কোন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করার পর আবিষ্করকগণ সুযোগ পেলেই তার সাথে দেশের কোন অঞ্চলের নাম বা বিখ্যাত ব্যক্তির নাম জুড়ে দিচ্ছেন। এতে বন্যপ্রাণী বিষয়ক গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের দেশের নাম ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী দিনের বাচ্চারা যখন এসব জীবের বৈজ্ঞানিক নাম পড়বে তখন তারা এসকল পরিচিত নাম দেখে অত্যন্ত পুলকিত হবে। নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করা তাই নিশ্চয়ই অনেক মজার একটা ব্যাপার বটে। 

যেসব বন্যপ্রাণী লোকালয়ের পাশে থাকে না, মানুষ থেকে দূরে বসবাস করে, সহজে খুঁজেও পাওয়া যায়না, আবার মানুষ উপস্থিতি টের পেলে পালিয়ে যায়, এদের নিয়ে গবেষণা করতে হলে, এদের সম্পর্কে সঠিক তথ্যপ্রমাণাদি জানতে হলে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়। সেটি বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা হতে পারে, যা গবেষকরা বনের ভিতরে আগে থেকে লুকিয়ে রেখে আসে, তারপর একসময় গিয়ে নিয়ে এসে পর্যালোচনা করে দেখে কী প্রাণীর ছবি বা ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়লো, আবার মাঝে মাঝে ড্রোনও ব্যবহার করা হয়। এভাবে মহাবিপন্ন, বিপন্ন, ও সংকটাপন্ন প্রাণিদের সন্ধানে বিভিন্ন আধুনিক টুলস ও টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে জরিপ চালিয়ে যাওয়া হয়, যার কয়েকটি নিচে তোমাদের জানার জন্য তুলে ধরা হলো:

  • রিমোট-নিয়ন্ত্রিত ড্রোন (Drone): রিমোট-নিয়ন্ত্রিত ড্রোন মূলত ক্যামেরা এবং সেন্সর দিয়ে সজ্জিত উড্ডয়নক্ষম যন্ত্র বিশেষ। এটি এরিয়াল জরিপ পরিচালনা করতে, বন্যপ্রাণীর জনসংখ্যা নিরীক্ষণ করতে এবং দুর্গম এলাকায় বন্যপ্রাণীর বাসস্থানের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যবহার করা হয়। 
  • ক্যামেরা ট্র‍্যাপিং (Camera Trapping): এগুলি গতি-সংবেদনশীল ক্যামেরা যা কোন প্রাণীর নড়াচড়ার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি বা ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। প্রাণিকে সরাসরি বিরক্ত না করে গুপ্ত ও নিশাচর প্রজাতি সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য এই পদ্ধতি বিশেষভাবে কার্যকর ও জনপ্রিয়। 
  • জিপিএস এবং জিআইএস (GPS and GIS): গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (GPS) এবং জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (GIS) সাধারণত গবেষকদেরকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, চলাচলের ধরণ এবং জনসংখ্যা বন্টন সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে। 
  • রিমোট সেন্সিং (Remote Sensing): রিমোট সেন্সিং বা দূরবীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করে এরিয়াল জরিপ, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের বৈশিষ্ট্য, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন এবং বন্যপ্রাণী জনসংখ্যার গতিশীলতার উপর মূল্যবান তথ্য প্রদান করা সম্ভব। 
  • অ্যাকোস্টিক মনিটরিং (Acoustic Monitoring): এই পদ্ধতিতে গভীর জঙ্গলে প্রাণীর কণ্ঠস্বর বা শব্দ রেকর্ড ও বিশ্লেষণ করতে বিশেষ ধরণের মাইক্রোফোন স্থাপন করা হয়। যে প্রাণিগুলো দৃশ্যত সনাক্ত করা কঠিন যেমন, বাদুড় বা নির্দিষ্ট পাখির প্রজাতি অধ্যয়নের জন্য এটি অত্যন্ত দরকারী। 
  • ডিএনএ বিশ্লেষণ (DNA Analysis): ডিএনএ স্যাম্পলিং এবং বিশ্লেষণ কৌশল কোন নমুনা (যেমন, চুল, মল, বা পালক সংগ্রহ করা) থেকে জেনেটিক ট্যাগিং, জনসংখ্যার আকার, জেনেটিক বৈচিত্র্য এবং প্রজাতি সমূহের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা প্রদান করতে পারে। 
  • রেডিও টেলিমেট্রি (Radio Telemetry): এতে পৃথক প্রাণীদের গতিবিধি এবং আচরণ ট্র্যাক করতে রেডিও ট্রান্সমিটার সংযুক্ত করা হয়। উন্নত টেলিমেট্রি সিস্টেম কোন প্রাণীর অবস্থান এবং বাসস্থান ব্যবহারের রিয়েল-টাইম ডেটা সরবরাহ করতে পারে।
  • মেশিন লার্নিং এবং এআই (Machine Learning and AI): এই প্রযুক্তিগুলি বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে সংগৃহীত বৃহৎ ডেটাসেট সমূহকে প্রক্রিয়া করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে যা আরও দক্ষভাবে বিভিন্ন প্রজাতি সনাক্তকরণ, কোন প্রজাতির জনসংখ্যা অনুমান এবং কোন প্যাটার্ন স্বীকৃতির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। 
  • এনভায়রনমেন্টাল ডিএনএ স্যাম্পলিং (Environmental DNA/eDNA Sampling): এই কৌশলটি কোন প্রাণির ডিএনএ ট্রেস (যেমন, জল বা মাটির নমুনা) সংগ্রহ করতে এবং বিশ্লেষণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সাহায্যে অনেক সময় বিলুপ্তপ্রায় ও পূর্বে অশনাক্তকৃত প্রাণীদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। 
  • থার্মাল ক্যামেরা (Thermal Camera): এটিও একটি আধুনিক পদ্ধতি। থার্মাল ক্যামেরা তাৎক্ষণিকভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণী শনাক্ত করতে পারে যেটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের খুঁজে বের করতে বেশ কার্যকর উপায়। 
  • ট্র‍্যাকিং ট্যাগ (Tracking Tag): এটা এক ধরণের সনাতন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কোন প্রাণীর পায়ের ছাপ দেখে তার সংখ্যা, প্রজাতি, বয়স ইত্যাদি শনাক্ত করা যায়।

7.3 সিটিজেন সায়েন্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণ

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিক যুগের উদ্ভাবনী উদ্যোগসমূহের মধ্যে সিটিজেন সায়েন্স অন্যতম। মূলত বন্যপ্রাণী মনিটরিং এর জন্য সমাজের জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা সমগ্র বিশ্বেই একটি প্রচলিত পদ্ধতি। কোন প্রজাতির পপুলেশন ও বিচরণ সম্পর্কে নাগরিকের অংশগ্রহণ ও তথ্য আদান-প্রদান বিভিন্ন গবেষণায় অনেক গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া সচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্য সংগ্রহ, আবাসস্থল সংরক্ষণেও সিটিজেন সায়েন্সের ভূমিকা অত্যন্ত অর্থবহ। আই ন্যাচারালিস্ট (iNaturalist) অ্যাপ সিটিজেন সায়েন্সের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই অ্যাপকে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সাথে তুলনা দেয়া যায়। বিভিন্ন এক্সপার্ট ও বিজ্ঞানীসহ সকলেই এই অ্যাপে তাঁদের ভাবনা, ছবি, ধারণা প্রকাশ করতে পারে। ধরো, তুমি একটি প্রাণীর নাম জানোনা, তুমি ছবি তুলে এই প্লাটফর্মে শেয়ার করলে যারা এই প্রাণী সম্পর্কে জানে, তারা সহজেই তোমাকে ঐ প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবে। ছবি ছাড়াও তুমি চাইলে প্রাণীর ডাক কিংবা পায়ের ছাপ দিয়েও তোমার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারবে। বিষয়টি কী দারুণ! তাই না?

কেস স্টাডি: দ্য গ্রেট ব্যাকইয়ার্ড বার্ড কাউন্ট (GBBC)

গ্রেট ব্যাকইয়ার্ড বার্ড কাউন্ট (GBBC) হলো একটি বার্ষিক সিটিজেন সায়েন্স ইভেন্ট যা ফেব্রুয়ারি মাসে চার দিনের বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমস্ত বয়সের লোকজনকে তাদের স্থানীয় এলাকায় পাখি পর্যবেক্ষণ ও গণনা করতে এবং একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের পরিদর্শনের তথ্যাদি প্রেরণ করতে উত্সাহিত করা হয়। GBBC পাখির জনসংখ্যা ও বিতরণ সম্পর্কে মূল্যবান ডেটা সংগ্রহ করে ডাটাবেজ আকারে সংরক্ষণ করে। এই ডেটাবেজ বিজ্ঞানীদের পাখির জনসংখ্যায় পরিবর্তন ট্র্যাক করতে, তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলগুলি সনাক্ত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উক্ত আবাসস্থলের হুমকির সঠিক কারণ ও প্রভাবগুলো বুঝতে সাহায্য করে৷ GBBC পাখি এবং তাদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড এর লোকদের সমন্বিত করে তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ায়। অংশগ্রহণকারীরা জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্পর্কে শিখে এবং পাখি ও তাদের বাসস্থান রক্ষার জন্য অনুপ্রাণিত হয়। জিবিবিসি অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি অভিন্ন সাম্প্রদায়িক বোধ জাগিয়ে তোলে যা পাখি উত্সাহী, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সহযোগিতা এবং জ্ঞান ভাগাভাগি করার মাধ্যমে পাখি সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সম্পর্কে বোঝাপড়া এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালানোর ক্ষেত্রে গ্রেট ব্যাকইয়ার্ড বার্ড কাউন্ট এর মতো সিটিজেন সায়েন্স কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলতঃ বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং সংরক্ষণ কর্মে জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে GBBC-এর মতো সিটিজেন সায়েন্স উদ্যোগ পাখি এবং মানুষ উভয়ের জন্য টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। 

7.4 তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্তকরণ

আজকের তরুণ সমাজ ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক; আগামীর বাংলাদেশ। তাদেরকে হতে হবে সমস্থ অনিয়ম, অন্যায়, ভোগবাদ আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও কঠোর। তবেই সমাজে বিদ্যমান অসঙ্গতিসমূহে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সকল কল্যাণমূলক কাজে তরুণদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে তরুণ প্রজন্মের ভুমিকাই সর্বাধিক। উল্লেখ্য, বর্তমান তরুণসমাজ স্মার্ট প্রজন্ম হিসেবে সুপরিচিত। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, পরিবেশ জ্ঞান, সামাজিক ন্যায্যতা ও সাম্য এবং নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে তরুণ সমাজ তাদের উদ্ভাবনী ধারণা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সম্মিলনে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যগুলি অর্জনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে। 

বর্তমানে তরুণদের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম ও নানিাবিধ উদ্যোগের কারণে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে মানুষ অধিকতর সচেতন হচ্ছে এবং পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগের ফলে অপরাধপ্রবণতাও দিনদিন কমছে। ইতোমধ্যে এসকল কর্মসূচী থেকে আরো নানাবিধ ধরনের সুফল আসতে শুরু করেছে। এই সুফলকে সাফল্যকে পরিণত করতে হলে দেশের সকল তরুণদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। তোমাদের মতো তারুণ্যই পারবে বন্যপ্রাণীর হারানো আবাসস্থলগুলো আবারও বন্যপ্রাণীর জন্য বসবাসের জন্য উপযুক্ত করে পরিণত করতে। খেয়াল করলে দেখবে, তোমাদের এলাকায় আগে অনেক জলাশয় ছিল, সেখানে অনেক জলজ প্রাণী বাস করতো, অনেক পাখি আসতো। উন্নয়নের অজুহাতে সেগুলোর অনেকটাই কালক্রমে ভরাট করে ফেলা হয়েছে কিংবা আবর্জনা ফেলে এমনভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে যে, সেখানে মাছসহ আর কোনো জলজ প্রাণী টিকে থাকতে পারছেনা। তোমরা নিজেদের এলাকায় মানুষকে বন্যপ্রাণী ও তার আবাসস্থলের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে পারো, তাদেরকে বুঝিয়ে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে ওইসব জলাশয় যেমন পুকুর, ডোবা, খাল, বিল ইত্যাদি পুনরুদ্ধার করতে পারো। পাড়া বা মহল্লার সবাই মিলে জলাশয়গুলো থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করে সেখানে জলজ গাছপালা, মাছ ও পাখি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে পারো। আরও খেয়াল করলে দেখবে, মানুষের বনভূমি জবরদখল ও অসচেতনভাবে গাছ কাটার ফলে তোমার এলাকায় ক্রমাগত ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল বা বনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পরিণামে অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো জোনাক জ্বলতে দেখা যায়না, শেয়ালের ডাক কিংবা ঘুঘুর ডাক শুনতে পাওয়া যায়না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণদের মতো স্থানীয় পর্যায়ে ‘ওয়াইল্ডলাইফ ক্লাব’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তোমরা এই জায়গাগুলো পুনরুদ্ধারে কাজ করতে পারো, নতুন করে বনায়ন করতে পারো অবক্ষয়িত বনাঞ্চলে। তবেই দেখবে, ধীরে ধীরে এসব জঙ্গলে ঠিক আগের মতোই ঘুঘু ডাকছে, শেয়াল দৌঁড়াচ্ছে; সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরে এসেছে। 

তোমাদের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়। অনেক সময় দেখবে, তোমার এলাকায় অনেকেই পরিযায়ী পাখি শিকার করে নিজেরা খাচ্ছে বা বিক্রি করছে। পার্বত্য এলাকায় গুঁইসাপ, সিলেটের দিকে কাছিম, সুন্দরবনের পাশের লোকালয়ে গুটিকয়েক অসাধু ও দুষ্কিৃতিকারী হরিণের মাংস, চামড়া শিং, এমনকি বাঘের চামড়াও বিক্রি করছে। অন্যান্য এলাকাতেও দেখবে বিভিন্ন ধরণের বনের পাখি, বানর ও অন্যান্য পশুপাখি লোকজন নিছক মজার ছলে আটকে রাখছে, অজ্ঞতাবসতঃ অকারণে তাড়া করে মেরে ফেলছে। অথচ তোমরা অবগত যে, এইসব কাজ অতি গর্হিত এবং আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। তাই তোমাদের এলাকায় এ ধরণের ঘটনা গোচরীভূত হলেই তাদেরকে প্রথমত সচেতন করবে; তা ফলপ্রসূ না হলে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটকে খবর দিবে; ক্ষেত্র বিশেষে ৯৯৯/৩৩৩-৪ হটলাইনসমূহে যোগাযোগ করতে পারো। তোমার পরিচয় গোপন রেখে তৎক্ষণাৎ ওই বন্যপ্রাণীকে উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং উদ্ধারকৃত প্রাণিটিকে তার আবাসস্থলে স্বীয় পরিবারের নিকট অবমুক্ত করা হবে। এরুপে তুমিও বাঁচাতে পারো একটি বন্যপ্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ জীবন; অবদান রাখতে পারো প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায়। আর এভাবে অচিরেই তোমাদের হাত ধরে প্রকৃতির সাথে নতুনরুপে রচিত হবে মানুষের বন্ধুত্ব; গড়ে উঠবে একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী। তারুণ্যের শক্তিতে ভর করে অচিরেই বাংলাদেশে মানুষ, প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থান (Living in Harmony with Nature) ও অধিকার এর ন্যায়সঙ্গত সুষম বন্টন সুনিশ্চিত হবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন এমনই একটি টেকসই সোনার বাংলার। বিখ্যাত গীতিকার কবির বকুল লিখেছেন-

‘‘প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের হয়ে গেলে বন্ধুত্ব

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন হবে সত্য। ’’